রাষ্ট্র সংস্কার: ডিএসএ বাতিলের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ শীর্ষ সন্ত্রাসীর মুক্তি?
শাফাআত হিমেল
প্রকাশ: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১১:৪৬ এএম
ছবি: সংগৃহীত
৫ আগস্ট গণঅভ্যুথানের মাধ্যমে ১৫ বছরের আওয়ামী লীগের ফ্যাসিস্ট শাসনামলের অবসানের পর ড. ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ৮ আগস্ট শপথ নেয়ার পর এই সরকারের প্রথম এক মাস অতিবাহিত হয় নানা চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে। প্রশাসনকে ঢেলে সাজানো, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা কিংবা দলীয় আশীর্বাদে নিয়োগ হওয়া উপাচার্য, প্রক্টরদের রদবদলের মধ্যেই দেশের বেশ কয়েকটি অঞ্চলে আঘাত আনে ভয়াবহ বন্যা।
কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্রের বসে থাকার কোনো সুযোগ নেই। এর মধ্যেই চলমান রাখতে হয়েছে সকল প্রশাসনিক কার্যক্রম। বন্যার্তদের উদ্ধার, ত্রাণ সহায়তা ও পুনর্বাসন, পুলিশের কর্মবিরতি ভেঙে দায়িত্বে ফেরানো, ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনা ও ঋণ খেলাপিদের থেকে ঋণের টাকা পুনরুদ্ধারেও বেশ কার্যকরী পদক্ষেপ নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ।
তবে একটি জায়গা জনমনে একই সঙ্গে বেশ হতাশা ও আশংকাও তৈরি করেছে, তা হচ্ছে সরকারের আইন ও বিচার বিভাগ।
আইন মন্ত্রণালয় ও বিচার বিভাগ দুটি ভিন্ন প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও প্রায়ই তাদের কাজের সীমারেখা আলাদা করা বেশ কঠিন হয়ে যায়। বিগত সরকার সব কিছুর সিদ্ধান্তের জন্য একদিকে তাকিয়ে থাকতো। বিচার বিভাগীয় বিষয়গুলোর বেশিরভাগ সিদ্ধান্তই আসতো আইন মন্ত্রণালয় থেকে। এখনও সেই ধারার কোনো ব্যতিক্রম হয়েছে বলে চোখে পড়েনি। আইন মন্ত্রনালয়ই যেন হয়ে উঠেছে বিচার ব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দু।
বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা অনুসারে এবারও সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পূর্ববর্তী সরকারের দলীয় নেতাকর্মীদের নামে ঢালাওভাবে মামলা দেয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র সংস্কার ও বিচার ব্যবস্থার পরিবর্তন আপাতদৃষ্টিতে শুধু মোড়ক পরিবর্তন হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।
একইসাথে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিএনপি-জামায়াতসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও মতাদর্শের যেসকল নেতাকর্মীদের হয়রানিমূলক মামলা দেওয়া হয়েছিলো , সেগুলো দ্রুততম সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তি দেয়া হচ্ছে যা অনেকাংশেই প্রশংসনীয়। কিন্তু সেই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কিছু শীর্ষ সন্ত্রাসী ও দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদেরও মুক্তি দেয়া কতটুকু যুক্তিসঙ্গত তা প্রশ্নের দাবিদার।
বিগত সরকারের আমলে সবচেয়ে আলোচিত বা সমালোচিত বিষয়গুলোর মধ্যে একটি ছিল ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ)। যে আইনের মাধ্যমে হয়রানির শিকার, গ্রেপ্তার কিংবা বিনাবিচারে কারাভোগ করতে হয় অগণিত সাংবাদিক, অ্যাক্টিভিস্টসহ অন্যান্য পেশার মানুষদের। হেনস্তা করা হয়েছে যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় বিষয়ে সরকারের নেয়া নীতির বিপক্ষে অনলাইনে আলোচনা সমালোচনা করা সাধারণ মানুষকেও।
রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব অক্ষুন্ন রেখে রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে মানুষ তার নিজের মতামত প্রকাশ করতে পারবে, যেটা তার সাংবিধানিক অধিকার। কিন্তু সরকার ও সরকারের আশপাশের মানুষদের সমালোচনা করলেই তাদের সেই অধিকার কেড়ে নেয়ার জন্য ২০১৮ সালে প্রণয়ন করা এই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পরিবর্তনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে এখনও কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।
আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ ও অপরাধ দমনে সরকারি বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার আধুনিকীকরণ করা যেমন জরুরি, ঠিক তেমনি জরুরি সেই আধুনিকীকরণের অপপ্রয়োগ করে সর্বজনের ব্যক্তিগত কথোপকথন কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নজরদারি করে ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ না করা। ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) মতো প্রতিষ্ঠানের বিলুপ্ত বা সংস্কার করাটাও এখন সময়েরই দাবি। যদিও এর পক্ষে বিপক্ষে ভিন্ন মতামত থাকতে পারে।
কোনো পরিস্থিতিতেই সরকার ও সরকারের সংস্থা যেন নাগরিকের অনুমতি ছাড়া তার ফোনে আড়িপাতার অধিকার রাখে না । যে কারণে গত ১৫ বছরের আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলের ভূল পুনরাবৃত্তি না করে গোয়েন্দা সংস্থার ফোনে আড়িপাতা ঠেকানো, বাক-স্বাধীনতা নিশ্চিত করা ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার রক্ষা করার যথাযথ উদ্যোগ এখনই গ্রহণ করা উচিত।
এ মুহূর্তে কোনো বিবেচনাতেই এনটিএমসির মতো সংস্থাগুলোর বিলুপ্তি বা সংস্কার ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের মতো জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো প্রাধান্য না দিয়ে দণ্ডপ্রাপ্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী এবং নিষিদ্ধ উগ্রপন্থি সংগঠনের নেতাকর্মীদের মুক্তি দেয়া রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হতে পারে না।
সন্ত্রাসী ও সমাজে নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী যে দলেরই হোক না কেন, তাদের বিষয়ে ছাড় দিয়ে অতীতের ভুল পুনরাবৃত্তি করার উচ্চাভিলাষী সিদ্ধান্ত নেয়ার মতো অবস্থান আমাদের দেশ ও সমাজের আছে কিনা তা সরকার সংশ্লিষ্টদের পুনর্বিবেচনা করা উচিত।
লেখক : সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক