প্রতিবেশীর প্রতি ভারতের নীতি কি পুনর্বিবেচনা দরকার
ছবি: সংগৃহীত
বিশ্বব্যবস্থা যখন একমুখী থেকে বহুমুখী ব্যবস্থার দিকে যাচ্ছে তখন ভারত একটি নেতৃত্বস্থানীয় শক্তি হিসেবে সামনে এগিয়ে আসছে। দেশটি জাতিসংঘে স্থায়ী সদস্যের দাবি করছে। তবে ওই ধরনের উচ্চপর্যায়ের নেতৃত্বের সঙ্গে দায়িত্বশীলতা বাড়ে অনেক। নেতৃত্বস্থানীয় একটি শক্তির দেশ হিসেবে তাকে বৈধতা, আচার-আচরণ, ন্যায়পরায়ণতা এবং নরম ও কঠোর শক্তি—এসব কিছুর ক্ষেত্রেই গ্রহণযোগ্যতার প্রমাণ রাখতে হবে। আর এসবই নিরাপত্তা পরিষদে বিশ্বের এই অঞ্চলের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর সংখ্যাগরিষ্ঠের মত এবং আকাঙ্ক্ষার প্রতিনিধিত্ব করার ক্ষেত্রে দেশটির নেতৃত্বকে সমর্থন দেবে।
যদিও অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে প্রতিবেশীদের সঙ্গে; সেটা ছোট এবং বড়, বন্ধু অথবা শত্রু দেশ হোক— ভারতের সম্পর্কে ঝামেলা আছে। চীন এবং পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে। তবে এটাও ঠিক বিশ্বের অনেক দেশই একে অন্যের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে, কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় তাদের মধ্যে একেবারে স্বাভাবিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। ভারতের দোরগোড়ায় থাকা ছোট্ট প্রতিবেশী চীনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। ভারতের বিজেপি সরকারের রাজনীতি অনেকাংশেই হিন্দুত্ববাদ ভিত্তিক। তারপরও কি করে বিশ্বের একমাত্র হিন্দু দেশ নেপাল ভারত থেকে দূরে থাকে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশ নজিরবিহীন সহায়তা পেয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ জনমত ভারতের বিরুদ্ধে চলে গেছে। মালদ্বীপের ক্ষেত্রে কি ঘটছে? মাত্র পাঁচ লাখ জনসংখ্যার ছোট্ট এই দ্বীপপুঞ্জে ভারত-বিরোধী মনোভাব মি. মুইজ্জোকে ক্ষমতায় নিয়ে এসেছে। সম্ভবত কেবল ভুটানেরই ভারতের সঙ্গে এক ধরনের সুসম্পর্ক আছে। তারপরও ডোকলাম ইস্যুতে ভারতের সমর্থন থাকা সত্ত্বেও ভুটান মনে করে সেখানে চীনের কিছু বলার অধিকার আছে।
উপরন্তু, ২০২৩ সালের অক্টোবরে ভুটানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর চীন সফর সাত লাখ জনসংখ্যার ছোট্ট এই দেশটি যে ভারতের অন্যান্য প্রতিবেশীর মতোই নিজেদের ভাবে।
এবার দেখা যাক আরেক আঞ্চলিক এবং নেতৃত্বস্থানীয় দেশ চীনের এসব প্রতিবেশী অর্থাৎ পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, মালদ্বীপ, ভুটান এবং বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক কেমন। চীন হয় এসব দেশের সঙ্গে কৌশলগত না হয় উন্নয়ন অংশীদারিত্বের সম্পর্ক বজায় রাখে। দেশটি খুব কমই এসব দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে। এমনকি ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিল এমন দেশগুলোও ভারতের অস্বস্তি সত্ত্বেও চীনের দিকে ঝুঁকে গেছে।
তবে কি আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ভারতের নীতি, মতবাদ, কাঠামোগত বাস্তববাদ বা কৌশলগত সংস্কৃতির আচরণই প্রতিবেশীদের জন্য অস্বস্তিকর? চলুন তবে ভারতের কিছু নীতি এবং মতবাদের দৃষ্টিভঙ্গি খতিয়ে দেখা যাক। চাণক্যের কৌটিল্যের নীতিই ভারতের পররাষ্ট্র নীতিতে বড় ধরনের ভূমিকা রাখে। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রই পররাষ্ট্র/নিরাপত্তা নীতি হিসাবে চার উপায়কে (কূটনীতি) ঘিরে আবর্তিত হয়। সম (সমঝোতা/জোট), দান (উপহার/ক্ষতিপূরণ), ভেদ (শত্রুর মধ্যে মতভেদ ও বিভেদ সৃষ্টি করা) এবং দণ্ড (সামরিক শক্তির ব্যবহার)। কথা হলো এসব কি প্রতিবেশীদের প্রতি ভারতের আচরণকে প্রভাবিত করছে? নাকি নীতিগত পর্যায়ে এসবের কোনো প্রাসঙ্গিকতা নেই? আচরণগত স্তরে এসবের প্রাসঙ্গিকতা বুঝতে চলুন দুটি মতবাদ বিশ্লেষণ করা যাক।
ইন্দিরা মতবাদ (১৯৮০ সালের জানুয়ারি থেকে ১৯৮৪’র অক্টোবর পর্যন্ত ইন্দিরা গান্ধী ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন)। এই মতবাদের প্রধান বিষয়গুলো হল: আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ায় ভৌগোলিক প্রভাব ও স্বার্থের জন্য ভারতের ভূমিকা রয়েছে। ভারতের নিরাপত্তার স্বার্থে দক্ষিণ এশীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ভূমিকা প্রয়োজন। আমরা ১৯৮৭ সালে শ্রীলঙ্কায় এবং ১৯৮৮ সালে মালদ্বীপে অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে অনাকাঙ্ক্ষিত ভারতীয় সামরিক হস্তক্ষেপ দেখেছি।
গুজরাল মতবাদ (১৯৯৬ সালের জুন থেকে ১৯৯৮’র মার্চ পর্যন্ত গুজরাল ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী ছিলেন)। ছোট প্রতিবেশীদের সঙ্গে ভারতের পারস্পরিক সম্পর্ক করতে চাওয়া উচিত নয়। দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশের ভূখণ্ড অন্য কোনো দেশের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যাবে না। অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ নয়। একে অপরের অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বকে সম্মান করা এবং শান্তিপূর্ণ দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা। এরপর বাংলাদেশ ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি বাহিনীর (পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি) সঙ্গে একটি শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করে।
ইন্দিরা মতবাদ অনেক বেশি কাঠামোগত বাস্তববাদী; ভারত সম্ভবত গুজরাল মতবাদে উদারতাবাদ থেকে দূরে সরে গেছে। এর ফলে কি ভারত প্রতিবেশী বন্ধুদের হারাচ্ছে? এই পরিস্থিতিতে প্রতিবেশীরা কি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ভারতের আসনের জন্য লড়তে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে? আর প্রতিবেশীরা যখন অস্বস্তিতে থাকে তখন বিশ্ব সংস্থা এমন দায়িত্বশীল পদে প্রতিযোগী হিসেবে ভারতের বৈধতাকে কীভাবে দেখবে?
বাংলাদেশ ফ্যাক্টর:
ভারতের বুঝা দরকার বাংলাদেশ অন্য প্রতিবেশীর মতো নয়। এখানে কিছু বাস্তবতা আছে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সবচেয়ে বেশি সীমান্ত এলাকা রয়েছে (প্রকৃতপক্ষে বিশ্বের মধ্যে পঞ্চম দীর্ঘতম সীমান্ত এলাকা)। কাঁটাতার আর রাজনৈতিক সীমানা পরিবার ও সম্প্রদায়কে বিভক্ত করলেও দুই পাশের মানুষের মধ্যে এখনো দৃঢ় বন্ধন রয়েছে। ভৌগোলিক বাস্তবতায় বাংলাদেশ ভারতের ভেতরে নেই, বরং ভারতের অংশ (ত্রিপুরা) বাংলাদেশের ভেতরে আছে। এটা আন্তঃসংযোগ। কিন্তু শেখার বাস্তবতা হলো, যখন ভারতের একটি শিশু স্কুলে যায় এবং প্রথমবার ভারতের মানচিত্র আঁকে, সে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকে। যখন শিশুটি তার শিক্ষকের কাছে জায়গাটি সম্পর্কে জানতে চায় সে দেখে অবচেতনভাবে বাংলাদেশকে সে জানে। কিন্তু ওই সময় হয়তো সে ভারতের সবগুলো রাজ্যের নাম জানে না। এটাই এক ধরনের চলতি বাস্তবতা। কেউ গভীর মনোযোগে মানচিত্রটি দেখলেই এটা সামনেু আসবে যে, ভারতের বগলের নিচে বাংলাদেশের অবস্থান।
কোনো কারণে যদি বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল বা অস্থিতিশীল করা হয় তাহলে তা হবে ভারতের বগলের নিচে ফোঁড়ার মতো। সেটি খুব অসুখী/বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা হবে। একই সঙ্গে ভারত ডুবে গেলে (রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিকভাবে) ভৌগোলিক মহাকর্ষীয় টানের কারণে বাংলাদেশও ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
তবে বাংলাদেশ ডুবলে ভারত হয়তো ডুববে না। তাই ভূ-কৌশলগত, অর্থনৈতিক এবং নিরাপত্তার কারণেই বাংলাদেশকে উপেক্ষা করা বা পুরো অংশের পরিবর্তে একটি অংশের পাশে থাকাটা বুদ্ধিমানের কাজ হতে পারে না। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক বিপ্লব এবং এর ফলাফল বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের দৃষ্টিভঙ্গি পুনর্বিবেচনায় ভারতের জন্য একটি শিক্ষা হতে পারে ।
পরিশেষে, এটা বোঝা খুবই প্রাসঙ্গিক যে ভারতের স্বার্থেই একটি গণতান্ত্রিক, স্থিতিশীল, হস্তক্ষেপহীন এবং সমৃদ্ধ বাংলাদেশ খুবই দরকারি। ভারতকে হয়তো আত্ম-অনুসন্ধান করতে হবে এবং প্রতিবেশীদের সঙ্গে আরও ভালো এবং টেকসই সম্পর্কের জন্য তার প্রতিবেশী নীতি, মতবাদ এবং কৌশলগত সংস্কৃতি পুনর্বিবেচনা করতে হবে।