ডাকসু
ভোট নিয়ে চারটি জরিপের নিরপেক্ষতা ও পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১০:১৯ পিএম
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে ভোটারদের মতামত নিয়ে প্রকাশিত চারটি জরিপের নিরপেক্ষতা ও পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এর মধ্যে তিনটি ‘জরিপে’ ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেল ও ভিপি প্রার্থী হিসেবে আবু সাদিক কায়েমকে এগিয়ে রাখা হয়েছে বিপুল ব্যবধানে। অভিযোগ উঠেছে, দুটি জরিপকারী সংগঠনের সঙ্গে ছাত্রশিবির সংশ্লিষ্টরাই জড়িত। একটি সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি আনাস বিন মুনীর ছাত্রশিবির প্যানেলেরই সদস্য পদপ্রার্থী।
আবার লেখক মহিউদ্দিন মোহাম্মদ ফেসবুকে ‘বাংলাদেশ পাবলিক একাডেমির’ করা একটি ‘জরিপ’ ফল প্রকাশ করেছেন। সেখানে ছাত্রদল প্যানেলের ভিপি প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খানকে বড় ব্যবধানে এগিয়ে রাখা হয়েছে। এসব জরিপের ‘নিরপেক্ষতা ও গ্রহণযোগ্যতা’ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ডাকসু নির্বাচনের প্রার্থীদের অনেকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা সংসদ নামের একটি সংগঠন আজ রবিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতিতে সংবাদ সম্মেলন করে তাদের জরিপ ফল প্রকাশ করে। তাদের দাবি, ৯০০ শিক্ষার্থীর ওপর তারা এ জরিপ চালিয়েছে। জরিপে ২০.৯২ শতাংশ উত্তরদাতা ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেল ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটে, ১৬.৪২ শতাংশ উত্তরদাতা ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলে এবং ৩৮.৮৫ শতাংশ শিক্ষার্থী স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ভোট দিতে পারে বলে আভাস দিয়েছেন।
অন্যান্য প্যানেলে ভোটের হার দেখানো হয়েছে– গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ সমর্থিত প্যানেল ৪.৭৬ শতাংশ, সমন্বিত শিক্ষার্থী সংসদ প্যানেলে ১.৬০ শতাংশ, ৭ বাম ছাত্র সংগঠন সমর্থিত প্যানেল ২.১০ শতাংশ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা সংসদ বলছে, এ জরিপের জন্য তারা অনলাইনে তথ্য সংগ্রহ করেছেন। উত্তরদাতাদের মধ্যে ৪৪ শতাংশ নারী এবং ৫৬ শতাংশ পুরুষ। ৪৫ শতাংশ আবাসিক এবং ৫৫ শতাংশ অনাবাসিক শিক্ষার্থী এ জরিপে অংশ নিয়েছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়ে জরিপ চালিয়েছে আরও দুই সংগঠন ‘ন্যারেটিভ’ ও ‘সোচ্চার’। এক সংবাদ সম্মেলনে জরিপের ফলাফল তুলে ধরেন ন্যারেটিভের প্রতিষ্ঠাতা আবদুল্লাহ মোহাম্মদ রুহেল। তিনি বলেন, মোট উত্তরদাতাদের প্রায় ৯৫ শতাংশ ডাকসু নির্বাচনে ভোট দিতে আগ্রহী। বাকি ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী আগ্রহী নন।
ভিপি পদে কাকে ভোট দেবেন, তা নিয়ে এখনো সিদ্ধান্ত নেননি প্রায় ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থী। বাকি ৭৫ শতাংশ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
ন্যারেটিভ বলছে, যারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাদের মধ্যে প্রায় ৪২ শতাংশ ভিপি পদে শিবির–সমর্থিত প্যানেল ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটের আবু সাদিক কায়েমকে ভোট দেওয়ার কথা বলেছেন। আর সাড়ে ১৬ শতাংশ উত্তরদাতা স্বতন্ত্র প্রার্থী শামীম হোসেনকে ভোট দেওয়ার কথা বলেছেন।
২০২৪ সালের ১৬ অক্টোবর ন্যারেটিভের উদ্যোগে একটি আলোচনা অনুষ্ঠান হয়, যার শিরোনাম ছিল ‘জুলাই গণবিপ্লব পরবর্তী ছাত্ররাজনীতি: প্রসঙ্গ ছাত্রশিবির’। সেই আলোচনায় আলোচকদের মধ্যে ছিলেন ছাত্রশিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার বর্তমান সভাপতি এস এম ফরহাদ এবং সাবেক কর্মী মোহাম্মদ ইশরাক।
এছাড়া ‘সোচ্চার’ নামের সংগঠনটির সভাপতি পদে থাকা আনাস ইবনে মুনির ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেল থেকে কার্যনির্বাহী সদস্য পদে নির্বাচন করছেন। ৯৯১ জন শিক্ষার্থীর ওপর চালানো জপিপের ফলাফল প্রকাশ করেছে সংগঠনটি।
সেখানে তারা বলছে, শিবিরের প্রার্থীর প্রতি সমর্থন রয়েছে ৩২ শতাংশ শিক্ষার্থীর। আর স্বতন্ত্র প্রার্থীর প্রতি সমর্থন রয়েছে ২২ শতাংশের। ছাত্রদলের প্রার্থীর প্রতি সমর্থন রয়েছে ৭ শতাংশ শিক্ষার্থীর।
৩৪ শতাংশ শিক্ষার্থী বলেছেন, তাদের কোনো মতামত নেই। বাকি ৫ শতাংশের বিষয়ে সোচ্চারের করা জরিপের সারসংক্ষেপে কিছু বলা হয়নি।
সোচ্চারের এই জরিপের ‘নিরপেক্ষতা’ নিয়ে যে প্রশ্ন উঠেছে, সে বিষয়ে প্রশ্ন করলে আনাস বিন মুনির বলেন, “এ গবেষণায় আমার কোনো হাত নেই। আমি সোচ্চারের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি। এটার যে মাদার প্রতিষ্ঠান, সেটিই এ জরিপ করেছে। আমাকে জড়িয়ে অন্য প্যানেল প্রকাশ করছে।”
বাংলাদেশ পাবলিক একাডেমি ও ভলান্টিয়ার সংস্থা ‘বেসরকারি’ পরিচালিত জরিপের ফল প্রকাশ করে লেখক মহিউদ্দিন মোহাম্মদ লিখেছেন, “জরিপে অংশ নিয়েছেন ২৪০ জন ইচ্ছুক ভোটার। জরিপে ছাত্রদল মনোনীত ভিপি প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান বিপুল ব্যবধানে এগিয়ে আছে।”
জরিপে দেখানো হয়েছে, ওই ২৪০ জনের মধ্যে ৪৬ শতাংশ আবিদকে ভোট দেবেন। বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের (বাগছাস) মনোনীত ভিপি প্রার্থী আব্দুল কাদেরকে ১৮ শতাংশ, ‘স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য’ প্যানেলের উমামা ফাতেমা ১২ শতাংশ এবং ছাত্রশিবিরের সাদিক কায়েম ৯ শতাংশ ভোট পাবেন।
ওই জরিপ অনুযায়ী, অন্যান্য প্রার্থী পাবেন ১১ শতাংশ ভোট, আর ৪ শতাংশ উত্তরদাতা এখনো সিদ্ধান্ত নেননি।
দৈবচয়নের ভিত্তিতে ১৮০ জন ছাত্র এবং ৬০ জন ছাত্রীকে এই জরিপের জন্য বাছাই করার কথা বলা সেখানে প্রতিবেদনে।
যা বলছেন প্রার্থীরা
এসব জরিপ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য প্যানেল থেকে জিএস পদপ্রার্থী আল সাদী ভূইয়া বলেছেন, তারা যাদের নিয়ে গবেষণা করেছে তারা হয়ত কোনো দলের। না হলে এ গবেষণা পূর্ণাঙ্গ না। এখানে তারা কাদের দিয়ে এ গবেষণা করিয়েছে সেটা নিয়ে প্রশ্ন আছে। আমি মনে করি, এটা কোনো গবেষণা হয়নি। এছাড়া তারা অনলাইনে যে জরিপ চালিয়েছে, সেখানে বট দিয়ে কাজ করারও সম্ভাবনা আছে। আমি মনে করি, এ সব নিরপেক্ষ না।
‘স্বতন্ত্র’ এজিএস প্রার্থী তাহমীদ আল মুদাসসীর চৌধুরী বলেন, “আমরা যখন মাঠে, সেখানে এক ধরনের অবস্থা দেখছি। আবার অনলাইনের এসব জরিপে দেখছি ভিন্ন অবস্থা। আপনারা জানেন যে প্রতিটি নির্বাচনের আগে মানুষকে প্রভাবিত করতে এ ধরনের গবেষণা প্রকাশ করা হয়। সেখানে নিজেদের নির্বাচনী ফলাফলকে নিজেদের দিকে আনার জন্য এ কাজ করে।
তাহমীদ আল মুদাসসীর আরও বলেন, ঠিক একই রকম, আপনি যদি ন্যারেটিভ, সোচ্চারের গবেষণা দেখেন তারা বলছে ছাত্রশিবির সবথেকে বেশি ভোট পাবে। আবার গবেষণা সংসদের জরিপে বলছে স্বতন্ত্র শিক্ষার্থীদেরই চাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। সেক্ষেত্রে এসব গবেষণার মনোভাব ও ত্রুটি সামনে আসছে। আমার মনে হয়, ৯ তারিখ শিক্ষার্থীরা এসবের জবাব ব্যালটের মাধ্যমে দেবে।
আব্দুল কাদের বলেন, নির্বাচনের আগে গবেষণা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে ন্যারেটিভ নামের সংগঠনের সভাপতি ছাত্রশিবিরের। সেখানে তাদের থেকে কীভাবে নিরপেক্ষ গবেষণা আশা করা যায়? আমার ধারণা, এটা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভ্রান্তি তৈরি করতে করেছে।”
জরিপের বিষয়ে কথা বলতে ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেলের ভিপি প্রার্থী সাদিক কায়েম, জিএস প্রার্থী এসএম ফরহাদ এবং এজিএস প্রার্থী মোহাম্মদ মহিউদ্দিন খানকে ফোন করা হলে তারা ধরেননি।
সূত্র: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম