Logo
Logo
×

সংবাদ

বন্ধ হচ্ছে ৯ আর্থিক প্রতিষ্ঠান

নিজস্ব প্রতিবেদক

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২২ আগস্ট ২০২৫, ০২:১৫ পিএম

বন্ধ হচ্ছে ৯ আর্থিক প্রতিষ্ঠান

বাংলাদেশের আর্থিক খাতে দীর্ঘদিনের অনিয়ম, লুটপাট ও অব্যবস্থাপনায় নাজুক অবস্থায় থাকা ৯টি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান অবশেষে বন্ধের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে—অমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে অক্ষমতা, বিপুল অঙ্কের খেলাপি ঋণ এবং মারাত্মক মূলধন ঘাটতির কারণে প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যত ‘অব্যবহারযোগ্য’ হয়ে পড়েছে। এ কারণেই অবসায়ন বা বন্ধের প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে।

গত বৃহস্পতিবার (২১ আগস্ট) বাংলাদেশ ব্যাংকে গভর্নরের সভাপতিত্বে এক জরুরি বৈঠকে সংশ্লিষ্ট বিভাগ এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়। গভর্নরের অনুমোদন পাওয়ার পরই ৯টি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিল করে ফাইন্যান্স কোম্পানি আইন ২০২৩ অনুযায়ী অবসায়ন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ব্যাংকের রেজুলেশন বিভাগ ইতিমধ্যে প্রাথমিক কাজ শুরু করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, এ সময়ে ক্ষুদ্র আমানতকারীরা যেন তাদের জমা ফেরত পান, সে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পাশাপাশি কর্মরত কর্মচারীরাও চাকরিবিধি অনুযায়ী সব সুযোগ-সুবিধা পাবেন।

বন্ধের উদ্যোগ নেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো হলো—পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, আভিভা ফাইন্যান্স, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, ফারইস্ট ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি), প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স, জিএসপি ফাইন্যান্স কোম্পানি এবং প্রাইম ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করতে সরকারের প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা। এর বড় অংশ ক্ষুদ্র আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেওয়ার পেছনেই ব্যয় হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক পর্যালোচনায় দেখা যায়, এসব প্রতিষ্ঠানের ঋণের বিপুল অংশই অগ্রহণযোগ্য হয়ে গেছে। এফএএস ফাইন্যান্সের ৯৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ ঋণই খেলাপি, প্রতিষ্ঠানটির পুঞ্জীভূত লোকসান ১ হাজার ৭১৯ কোটি টাকা। ফারইস্ট ফাইন্যান্সের ৯৮ শতাংশ ঋণ খেলাপি, লোকসান ১ হাজার ১৭ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানির খেলাপি ঋণ ৯৭ দশমিক ৩০ শতাংশ, লোকসান ১ হাজার ৪৮০ কোটি টাকা। ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৩ হাজার ৯৭৫ কোটি টাকা, এর ৯৬ শতাংশই অগ্রহণযোগ্য, লোকসান দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ২১৯ কোটি টাকা।

পিপলস লিজিংয়ের ৯৫ শতাংশ ঋণ খেলাপি, লোকসান ৪ হাজার ৬২৮ কোটি টাকা। আভিভা ফাইন্যান্সের খেলাপি ঋণ ৮৩ শতাংশ, লোকসান ৩ হাজার ৮০৩ কোটি টাকা। প্রিমিয়ার লিজিংয়ের খেলাপি ঋণ ৭৫ শতাংশ, লোকসান ৯৪১ কোটি টাকা। জিএসপি ফাইন্যান্সের খেলাপি ঋণ ৫৯ শতাংশ, লোকসান ৩৩৯ কোটি টাকা। প্রাইম ফাইন্যান্সের খেলাপি ঋণ ৭৮ শতাংশ, লোকসান ৩৫১ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ফাইন্যান্স কোম্পানি আইন ২০২৩-এর ৭(১) ধারায় উল্লেখ আছে—আমানতকারীর স্বার্থবিরোধী কার্যক্রম, দায় শোধে অক্ষমতা এবং মূলধন সংরক্ষণে ব্যর্থতার কারণে কোনো প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিল করা যায়। একই আইনের ৭(২) ধারায় বলা আছে, লাইসেন্স বাতিলের আগে ১৫ দিনের মধ্যে কারণ দর্শানোর সুযোগ দিতে হয়। গত ২২ মে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। নির্ধারিত সময়ে সন্তোষজনক জবাব না পাওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক অবসায়নের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়।

বর্তমানে দেশে মোট ৩৫টি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে ২০টিকে সমস্যাগ্রস্ত হিসেবে চিহ্নিত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এসব প্রতিষ্ঠানের ঋণের পরিমাণ ২৫ হাজার ৮০৮ কোটি টাকা, যার মধ্যে ২১ হাজার ৪৬২ কোটি টাকা খেলাপি। খেলাপির হার ৮৩ দশমিক ১৬ শতাংশ। অথচ বন্ধকি সম্পদের মূল্য মাত্র ৬ হাজার ৮৯৯ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২৬ শতাংশের সমান।

অন্যদিকে তুলনামূলক ভালো অবস্থায় থাকা ১৫টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণের হার মাত্র ৭ দশমিক ৩১ শতাংশ। তারা গত বছর ১ হাজার ৪৬৫ কোটি টাকা মুনাফা করেছে এবং তাদের মূলধন উদ্বৃত্ত রয়েছে ৬ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে আমানতের পরিমাণ ৪৮ হাজার ৯৬৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে সমস্যাগ্রস্ত ২০ প্রতিষ্ঠানের আমানত ২২ হাজার ১২৭ কোটি টাকা। এ ছাড়া অন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে তাদের দায় রয়েছে ৫ হাজার ১৬৪ কোটি টাকা। গ্রাহকদের ব্যক্তিগত নিট আমানতের পরিমাণ প্রায় ৪ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা, যা ফেরত দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক প্রাথমিক ধাপে জোগান দেওয়ার পরিকল্পনা করছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আশ্বাস, অবসায়ন প্রক্রিয়ায় আমানতকারীরা যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হন, সে বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখা হবে। একইসঙ্গে প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মচারীরা চাকরিবিধি অনুযায়ী সব ধরনের সুবিধা পাবেন।


Logo

ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন