অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করতে কাজ করছে সরকার: ড. ইউনূস

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৯ জুলাই ২০২৫, ১০:১৪ পিএম

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, নতুন একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা ঘিরে তারা জাতীয় ঐকমত্য গড়ে তোলার জন্য কাজ করছেন, যা ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক, অংশগ্রহণমূলক ও বিশ্বাসযোগ্য’ নির্বাচন নিশ্চিত করতে পারবে।
মঙ্গলবার (২৯ জুলাই) জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে তিনি এমন মন্তব্য করেন। অধ্যাপক ইউনূস বলেন, আমাদের লক্ষ্য পরিষ্কার, আমরা এমন একটি সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চাই, যেখানে সব বাংলাদেশি শান্তিতে, গর্বের সঙ্গে, স্বাধীনতা ও মর্যাদার সঙ্গে বসবাস করতে পারবেন।
তিনি বলেন, আমাদের কাজ এখনো শেষ হয়নি। আমাদের সংস্কার কর্মসূচির পাশাপাশি আমরা গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য দায়ীদের আইনি জবাবদিহির আওতায় আনতে কাজ করছি।
তবে ন্যায়বিচার কেবল শাস্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি। ‘ন্যায়বিচার মানে—রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা যেন আর কখনো জনগণকে দমন, নিশ্চুপ বা ধ্বংস করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার না হয়।’
অনুষ্ঠানে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জামায়াত আমির ডা. শফিকুর রহমান, ভুক্তভোগী পরিবারের প্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতারা বক্তব্য দেন।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘গত বছরের ঘটনাগুলো স্মরণ করতে গিয়ে আমরা তাদের কথা মনে করি—যারা এই স্বপ্নের জন্য জীবন দিয়েছেন। তাদের আত্মত্যাগ আমাদের ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায়ের পথ তৈরি করেছে। তারা একটি নতুন বাংলাদেশ নির্মাণ করেছেন—যা আশাবাদ, মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক পুনর্জাগরণের ওপর প্রতিষ্ঠিত।
জাতিসংঘ মানবাধিকার মিশন, ঢাকা এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে, যেখানে জ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক নেতা, নাগরিক সমাজ, তরুণ প্রতিনিধি ও আন্তর্জাতিক অংশীদাররা অংশ নেন।
প্রধান উপদেষ্টার অনুরোধে জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনারের কার্যালয় (ওএইচসিএইআর) ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের ঘটনাবলি নিয়ে একটি স্বাধীন তথ্য-অনুসন্ধান মিশন পরিচালনা করে।
এই মিশনের প্রতিবেদন ২০২৫ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত হয়, যেখানে বিস্তৃত তথ্য ও ভবিষ্যতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ দেওয়া হয়।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে আমি জাতিসংঘকে ধন্যবাদ জানাই—আমাদের সবচেয়ে অন্ধকার সময়ে পাশে থাকার জন্য। আমি ভবিষ্যতেও এই অংশীদারত্বকে এগিয়ে নিতে আশাবাদী।’
এই আয়োজন ছিল জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রথম বার্ষিকী উপলক্ষে—যা বাংলাদেশের ইতিহাসে এক গভীর তাৎপর্যের মুহূর্ত।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘এটি ছিল এমন একটি মুহূর্ত, যখন হাজার হাজার নারী-পুরুষ—অধিকাংশই তরুণ—অত্যাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন এবং আমাদের দেশের মর্যাদা ও ভবিষ্যৎ পুনরুদ্ধার করেছিলেন। তাদের সাহস কেবল আমাদের জনগণের হয়ে নয়, গোটা মানবতার পক্ষেই উচ্চারিত হয়েছে।’
তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়—বিশেষত জাতিসংঘের অবিচল সমর্থনের কথা স্বীকার করেন, যারা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে রোহিঙ্গা সংকট এবং সর্বশেষ ২০২৪ সালের জুলাই ও আগস্টের কঠিন সময়েও বাংলাদেশের পাশে ছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাতিসংঘ সকল মানুষের অবিচ্ছেদ্য অধিকার রক্ষা ও সংজ্ঞায়নের উদ্যোগ নেয়—ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ বা মর্যাদা নির্বিশেষে।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণা আমাদের পৃথিবীর নৈতিক দিশারি হয়ে ওঠে, এবং এর মূলনীতি বাংলাদেশের সংবিধানেও দীর্ঘদিন ধরে অন্তর্ভুক্ত।’
গত ১৬ বছরে এই অধিকার বারবার অস্বীকার করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
‘আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো দখল হয়ে যায়। স্বাধীনতা খর্ব করা হয়। শাসনব্যবস্থায় সহিংসতা হয়ে ওঠে প্রধান অস্ত্র। গত জুলাইয়ে আমাদের সমাজ ঐক্যবদ্ধভাবে এই বাস্তবতাকে প্রত্যাখ্যান করেছে,’ বলেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ স্পষ্টতা, সংকল্প ও অসাধারণ সাহসিকতার সঙ্গে নিজেদের অধিকার পুনরুদ্ধার করেছে।’
গত বছরের আগস্টে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিষ্ঠার পরপরই অধ্যাপক ইউনূস মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তদন্তে ওএইচসিএইচআরকে স্বাধীন অনুসন্ধান পরিচালনার জন্য অনুরোধ জানান—এই সময়কাল ছিল ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট।
‘আমরা বিশ্বাস করতাম, নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য সত্য-উদঘাটন শুধু ন্যায়বিচারের জন্য নয়, বরং নিরাময়ের জন্যও অত্যন্ত জরুরি।’
২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত হাইকমিশনারের প্রতিবেদনে এই হত্যাকাণ্ডের ভয়াবহতা প্রকাশ পায়। যাতে দেখা গেছে, জুলাইয়ের কয়েক সপ্তাহেই আনুমানিক ১ হাজার ৪০০ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, এই সহিংসতা ছিল পদ্ধতিগত, পরিচালিত এবং পূর্ববর্তী শাসনব্যবস্থার সর্বোচ্চ স্তর থেকে সমন্বিতভাবে সংঘটিত। অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘এতে সম্ভাব্য মানবতাবিরোধী অপরাধের তাৎক্ষণিক উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।’
এই অনুসন্ধানের তথ্য আন্তর্জাতিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাও সমর্থন করেছে—যার মধ্যে বিবিসি ও আল জাজিরার প্রতিবেদন উল্লেখযোগ্য।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা হাইকমিশনারের কার্যালয়ের প্রতি কৃতজ্ঞ—তারা কেবল মানবাধিকার লঙ্ঘনকে নথিভুক্ত করেনি, বরং একটি বিস্তৃত সুপারিশমালা দিয়েছে, যাতে ভবিষ্যতে এমন ঘটনা আর কখনো না ঘটে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা এসব সুপারিশ অন্তর থেকে গ্রহণ করেছি—অন্য কারো দায়ে নয়, নিজেদের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে।’
সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই ব্যাপক সংস্কার শুরু করেছে বলে জানান অধ্যাপক ইউনূস।
‘আমরা ফৌজদারি কার্যবিধি সংশোধন করেছি এবং জোরপূর্বক গুম প্রতিরোধবিষয়ক আন্তর্জাতিক সনদে যোগ দিয়েছি। চলতি মাসেই আমরা ওএইচসিএইচআরের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক সই করেছি, যাতে ঢাকায় একটি সহায়ক মিশন প্রতিষ্ঠা করা যায়,’ বলেন তিনি।
এই মিশন সংস্কার কর্মসূচিতে কারিগরি সহায়তা দেবে এবং মানবাধিকার রক্ষায় সরকারি প্রতিষ্ঠান, স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ও নাগরিক সমাজকে সক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করবে।
‘অন্তর্বর্তী সরকারের শুরু থেকেই জাতিসংঘ আমাদের রূপান্তর প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার।’ তিনি বলেন, ‘আমি মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসকে ধন্যবাদ জানাই—তার অবিচল সমর্থন ও সংহতির জন্য এবং এ বছরের মার্চে বাংলাদেশ সফরের জন্য।’
তিনি জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক, ওএইচসিএইচআরের ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং টিম, জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গোয়েন লুইস এবং মানবাধিকার উপদেষ্টা হুমা খানকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানান তাদের অসাধারণ ও ঐতিহাসিক অবদানের জন্য।