জঙ্গি বিমানের বৈমানিক রক্তাক্ত অবস্থায় ৪৫ মিনিট একটি কক্ষে আবদ্ধ ছিলেন: প্রত্যক্ষদর্শী

পশ্চিমের আকাশ থেকে চীনের তৈরি এফ-৭ বিজিআই জঙ্গি বিমানটি মাইলস্টোন স্কুল এন্ড কলেজের মধ্যে বিধ্বস্ত হওয়ার আগে বৈমানিক ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলাম প্যারাসুট ব্যবহার করে বাঁচার চেষ্টা করেন।
প্যারাসুটসহ তিনি ঢাকার উত্তরার মাইলস্টোন ক্যাম্পাসের খেলার মাঠের পাশে অবস্থিত প্রশাসনিক ভবনের টিনের চালা ভেঙে শারীরিক শিক্ষা বিভাগের একটি রুমের মধ্যে গুরুতর আহত অবস্থায় দীর্ঘক্ষণ পড়ে ছিলেন।
রক্তাক্ত বৈমানিক ও উদ্ধার তৎপরতা
ঘটনাস্থলের প্রত্যক্ষদর্শী এবং মাইলস্টোনের সাঁতার প্রশিক্ষক আশরাফুল ইসলাম জানান, "তার মাথা দিয়ে রক্ত বের হচ্ছিল। পা থেঁতলে গিয়েছিল। প্লেনের চেয়ারের উপরে অচেতন অবস্থায় পড়েছিলেন। প্রায় ৪৫ মিনিট পরে তাকে শনাক্ত করে দ্রুত হেলিকপ্টারে করে নিয়ে যাওয়া হয়। রক্তক্ষরণ কমানো গেলে হয়তো তিনি বেঁচে যেতেন।"
তিনি আরও বলেন, "আমি একটু দূরেই ছিলাম। হঠাৎ একটা ছোট আকারের শব্দ শুনতে পাই আর তার পরপরই আরেকটি বড় আকারের শব্দ ।"
শারীরিক শিক্ষা শিক্ষকদের কক্ষটির ভেতরে তখন দুজন শিক্ষক ছিলেন। বড় ধরনের শব্দ শুনে তারা রুম থেকে বেরিয়ে আসেন, কিন্তু কী ঘটেছে তা বুঝতে পারেননি।
সাঁতার প্রশিক্ষক আশরাফুল ইসলাম জানান, "টিনের উপরে শব্দ হওয়াতে আমি ভেবেছি হয়তো প্লেনের চাকা পড়েছে। কিন্তু এখানে যে পাইলট পড়েছে সেটা আমি জানতাম না।"
তিনি আশেপাশে থাকা লোকজনকে বিষয়টি জানানোর চেষ্টা করলেও কেউ তার কথা শোনেননি।
পরে তিনি নিজে উঠে দেখতে যান এবং বিল্ডিংয়ের পাশে গাছে প্যারাসুট আটকে থাকতে দেখেন।
স্কুলের দিকে ছুটে গিয়ে তিনি বুঝতে পারেন সেখানে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়েছে।
আর একজন প্রত্যক্ষদর্শী এবং কলেজটির বাণিজ্য শাখার ছাত্র তালহা জুবায়ের বলেন, মাত্র ১৫-২০ মিনিটের মধ্যেই সেনাবাহিনী, ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্স, এবং বিমানবাহিনী ঘটনাস্থলে চলে আসে। উদ্ধার কাজ দ্রুত শুরু হয়।
বিমান বাহিনীর পক্ষ থেকে প্রথমেই গুরুতর আহত স্কুল শিক্ষার্থীদের হেলিকপ্টারে করে সরিয়ে নেওয়া হয়। এর প্রায় ৪৫ মিনিট থেকে ১ ঘন্টা পর পাইলটকে শনাক্ত করা হয় এবং তাকেও হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
সে সময় আশরাফুল ইসলামের কথায় আরো কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী সায় দেন।
আহতদের খোঁজ এবং পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ
রুমের ভেতরে থাকা দুই শিক্ষক শব্দ শুনে দ্রুত বেরিয়ে যান, তখনও তারা কী ঘটেছে বুঝতে পারেননি।
বাইরে এসে পাশের বিল্ডিংয়ে তারা বিমান বিধ্বস্ত হতে দেখেন, কিন্তু রুমের ভেতরে যে পাইলট পড়ে আছেন তা বুঝতে পারেননি। পরবর্তীতে একজন পিয়ন সাহস করে চার্জে থাকা মোবাইল সংগ্রহ করতে গিয়ে আহত বৈমানিককে দেখতে পান।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, আহতদের সবাইকে বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠানোর পর উদ্ধারকাজে নিয়োজিত সদস্যরা বিধ্বস্ত জঙ্গি বিমানের অংশগুলো সন্ধ্যার পর সংগ্রহ করে নিয়ে যায়।
তারা আরও জানান, সোমবার বিমানটি বিধ্বস্ত হওয়ার পর অন্তত তিনটি হেলিকপ্টার মাইলস্টোন ক্যাম্পাসে অবতরণ করে। প্রথমটিতে নিহত শিক্ষার্থীদের, দ্বিতীয়টিতে আহত বৈমানিককে এবং তৃতীয়টিতে গুরুতর আহতদের নিয়ে যাওয়া হয়। "প্রথমটিতে দশটি প্যাকেট ভরে নিয়ে যাওয়া হয় তারা বেঁচে ছিল বলে মনে হয়নি।"
মঙ্গলবারও দুর্ঘটনাস্থলে অনেক শিক্ষার্থী ও দর্শনার্থীদের ভিড় দেখা যায়। ক্ষতিগ্রস্ত ভবন থেকে তখনও লাশের গন্ধ আসছিল এবং পুড়ে যাওয়া বই, ব্যাগ বা ফুটবলের মতো খেলার সামগ্রী ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল।
মঙ্গলবারও স্কুলের আকাশ দিয়ে একের পর এক যাত্রীবাহী উড়োজাহাজ পার্শ্ববর্তী হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামছিল।
আর সারাদিনই স্কুলের আশেপাশে বিক্ষোভ চলে এবং শিক্ষার্থীদের দেখতে আসেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল, শিক্ষা উপদেষ্টা সিআর আবরার, এবং প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। প্রায় ৯ ঘণ্টা পর ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ ও স্থানীয় জামায়াত ইসলামের নেতৃবৃন্দের সহায়তায় তারা মাইলস্টোন ক্যাম্পাস ত্যাগ করেন।
এই দুর্ঘটনায় শিশু শিক্ষার্থীসহ অন্তত ৩২ জনের নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে এবং দেড় শতাধিক গুরুতর আহতদের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে।
বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খান বলেছেন, পাইলট যখন বুঝতে পারছিলেন, বিমানটি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে, তখনো তিনি সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলেন সেটিকে কোনো খালি মাঠে নামাতে। কিন্তু তাঁর সেই শেষ প্রচেষ্টা সফল হয়নি।
বিমানটি একটি ভবনের ওপর বিধ্বস্ত হয়। এই মূল্যবান সময়ে জরুরি নির্গমনের প্রক্রিয়া বিলম্বিত হয়। পরে নিজের জীবন উৎসর্গ করতে হয় পাইলটকে।
মঙ্গলবার দুপুরে ঢাকার কুর্মিটোলা বিমানঘাঁটির এ কে খন্দকার প্যারেড গ্রাউন্ডে বিমান বিধ্বস্তে নিহত ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলামের রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় আয়োজিত ফিউনারেল প্যারেডে তিনি এসব কথা বলেন।