পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে সব স্টেকহোল্ডারদের সম্মতি লাগবে : ঊষাতন তালুকদার

ছবি: সংগৃহীত
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সহ-সভাপতি ঊষাতন তালুকদার বলেছেন, বাংলাদেশের সরকারের পক্ষে পার্বত্য চুক্তি সম্পাদনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের সকল স্টেকহোল্ডারদের সম্মতি ছিল। তাই বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও অবশ্যই আমাদের সকলের সম্মতি প্রয়োজন হবে।
তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বাধা হিসেবে আমরা দেখি সেগুলো সামরিক ও বেসামরিক আমলা ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী। অনেক ত্যাগ তিতীক্ষার বিনিময়ে পাওয়া চুক্তি বাস্তবায়নের পরিবর্তে পাহাড়ের মানুষ প্রতারিত হয়েছে। এই সরকার ‘আদিবাসী’দের প্রতি এই নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা জারি রেখেছে। সম্প্রতি চিংমা খিয়াংসহ এইদেশে আদিবাসী নারীদের উপর সংঘটিত সহিংসতার একটিরও সুষ্ঠু বিচার পায়নি আদিবাসী জনগণ।
আজ শুক্রবার (২০ জুন) রাজধানীর ধানমন্ডি উইমেন্স ভলান্টারি অ্যাসোসিয়েশন মিলনায়তনে (ডব্লিউভিএ) ‘সাম্প্রতিক পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতি ও পার্বত্য চুক্তি যথাযথ বাস্তবায়নে করণীয় শীর্ষক’ আলোচনা সভায় প্রধান আলোচক হয়ে উপস্থিত থেকে এসব কথা বলেন ঊষাতন তালুকদার। আলোচনা সভাটির আয়োজন করে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম।
ফোরামের তথ্য ও প্রচার সম্পাদক হিরন মিত্র চাকমার সঞ্চালনায় সভায় সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সহ-সভাপতি অজয় এ মৃ। সভায় নির্ধারিত বিষয়বস্তুর উপর প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অদিবাসী অধিকারকর্মী সতেজ চাকমা।
ঊষাতন তালুকদার আরও বলেন, আমিও বিশ্বাস করি যে এই দেশের অবস্থা বদলাবে। কিন্তু আমার প্রশ্ন- এই দেশটি বদলাতে বদলাতে আদিবাসীরা এই দেশে থাকবে কিনা? এই রাষ্ট্র তাদেরকে থাকতে দিবে কিনা! সরকার দেখায় এখানে পার্বত্য চুক্তি হয়েছে। আদিবাসীরা সুখে আছে। একটি কথা আছে, লাঠি দিয়ে আঘাত করলে দেখা যায়, কিন্তু বস্তা দিয়ে ঢলা দিলে তা দেখা যায় না। এখন ধর্মীয় বিষয়েও করছে। সমতলে কয়েকবার জরুরি অবস্থা জারি করার পর আপনারা এখানকার পরিস্থিতি দেখেছেন। কিন্তু সেই অনেক আগে থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে জরুরি অবস্থা চালু রয়েছে। এইদেশে একপ্রকার বিচারহীনতার অপসংস্কৃতি চলমান রয়েছে। পাহাড়ের ও সমতলের আদিবাসীদের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেছে। বাংলাদেশের সার্বভৈৗমত্বটা রক্ষা করে বাংলাদেশের আদিবাসী সমাজ, আমরা এই দেশে ভালোভাবে বসবাস করতে চায় এই কথা ব্যক্ত করেন। কিন্তু আদিবাসীদেরকে যাতে অন্য পথে ধাবিত হতে বাধ্য করা না হয়।
সভায় ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এইদেশে মিডিয়ার উপর হস্তক্ষেপর করার কর্তৃপক্ষ আছে। বাংলাদেশে আদিবাসী নেই এইটি আন্তর্জাতিক মহলে প্রচার করতে পারলেই প্রত্যেক সরকারের লাভ হয়। বাংলাদেশের আদিবাসীদের অধিকারের স্বীকৃতি না দেওয়ার ক্ষেত্রে একধরনের ঐকমত্য আছে যে, এই দেশে আদিবাসী নেই সেটি প্রচার করতে হবে। আদিবাসীদেরকে নিম্নতর পর্যায়ে ফেলে দেওয়ার জন্য এখানে শাসনতন্ত্রে এক ধরনের ঐক্যমত্য রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, গণঅভ্যুত্থানের পর অনেকগুলো সম্ভাবনার তৈরি হয়েছে। সম্ভাবনার প্রেক্ষিতে বিভিন্ন খাতে সংস্কার নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। অন্তর্বতীকালীন সরকারের পিছনে যারা সবচেয়ে শক্তিশালী পিলার হিসেবে কাজ করছে তারা আদিবাসী বিষয়টি মানতে পারেন না। বাস্তবে পার্বত্য চট্টগ্রামে এক ধরনের শাসনব্যবস্থা বিদ্যমান। সেটি হচ্ছে সেনাশাসন ব্যবস্থা।
তিনি আরও বলেন, আদিবাসীদেরকে আরও সচেতন হতে হবে। এবং এইটা শুধু আদিবাসীদের অধিকারের বিষয় না, এইটা পুরো বাংলাদেশের নাগরিকদের অধিকার হিসেবে ভাবতে হবে। কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থাকে পতন ঘটিয়ে কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠা করতে চাওয়াটা উচিত না।
সভায় শামসুল হুদা বলেন, ২৪ গণঅভ্যত্থানের পরের বাংলাদেশ ও আগের বাংলাদেশ এক না। এখানে অনেক কিছুর পরিবর্তন হয়েছে। আমি আশা করি, আদিবাসীদের জন্য আমাদের যে লড়াই তা বৃথা যাবে না। আমরা সবসময় একটি যুদ্ধের পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। আমি গণঅভ্যুত্থানে যে আশাবাদগুলো দেখেছি তা এখন অনেক দূরে সরে যাচ্ছে। আপাতত দৃষ্টিতে দেখনে এইটি মনে হবে যে আদিবাসীদের সঙ্গে প্রতারণা করা হচ্ছে, কিন্তু আসলে শাসকগোষ্ঠী প্রতারণাটি নিজেদের সাথেই করছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে যদি সীমাবদ্ধতা থেকে থাকে, তাহলে আমরা সেগুলো নিয়ে পুনরায় আলোচনা করব। আমরা ভেবেছিলাম এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আদিবাসীদের সমস্যাগুলোকে আদিবাসীদের লেন্স দিয়ে দেখবেন। কিন্তু তা হয়ে উঠেনি। আমরা যদি তাঁদের লেন্স দিয়ে দেখি তাহলে তারা এই সরকারের আমলেও কিছুই পায়নি। বরঞ্চ তাঁরা নিপীড়ন ও শোষণ-বঞ্চনার শিকার হচ্ছে।
রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ৩৩ বছর আগে লোগাং গণহত্যার প্রতিবাদ মিছিল ও সমাবেশে তরুণদের যে টগবগের চোখ আমি দেখেছি, সেই দ্রোহভরা চোখ আমি এখনকার সকল আদিবাসী তরুণদের চোখে দেখি। বাংলাদেশের আদিবাসীদের সমস্যাকে লাঘব করার জন্য আমরা মনে করি তা রাজনৈতিকভাবে সমাধান করতে হবে। কিন্তু যারা ক্ষমতায় থাকেন তারা সেটা মনে করে কিনা এইটাই আসল কথা। তিনি আরও বলেন, ড. ইউনূস পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিকে আগামীর শাসকদের জন্য রাখতে চান, কিন্তু রাখাইনের মানবিক করিডোর করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন। এই সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পুরাপুরি বাস্তবায়ন করতে না পারেন, অন্তত সেই বিষয়ে একটি পদক্ষেপ নেন। বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রাম এখন ভূরাজনীতির জায়গায় একটি বিশেষ অঞ্চল। সেখানকার অবস্থা ভালো না থাকলে, পুরো বাংলাদেশও ভালো থাকবে না।
সঞ্জীব দ্রং বলেন, আমি যখন প্রথম আলোতে কলাম লেখতাম তাতে আমি লিখতাম, ”একটা দেশ কতটা মানবিক, গণতান্ত্রিক সেটা বুঝতে হলে একজন আদিবাসী মানুষকে , চা বাগানের শ্রমিকদের জিজ্ঞেস করতে হবে। একটি দেশে পিছিয়ে পড়া মানুষরা যদি ভালো থাকে, তাহলেই বুঝবেন দেশের সকল মানুষ ভালো আছে।” ছয়টি সংস্কার কমিশনে অন্তত আদিবাসীদের কথাগুলো অন্তত এসেছে। আমি আশা রাখব আগামীতে যে সরকার আসব তারাও যাতে আদিবাসীদেরকে মনে রাখে। রাষ্ট্র এখন অনেক শক্তিশালী হয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্র যখন দানবের মত আচরণ করে তখন সেখানকার নাগরিকদের যাওয়ার মতো কোনো জায়গা থাকেনা। বাংলাদেশও আদিবাসীদের জন্য ঠিক তাই। বর্তমানে যারা নতুন স্বপ্নের কথা বলেন, তাদেরকে অবশ্যই এইদেশের আদিবাসী সহ সকল প্রান্তিক মানুষদের মানবাধিকারের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে।
ড. খায়রুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাটি হচ্ছে শাসন প্রণালীর সমস্যা। ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের পর গঠিত বর্তমান সরকারের বিভিন্ন কমিশনের রিপোর্টের মাধ্যমে যে বিষয়টা উঠে এসেছে সেটা হচ্ছে বাংলাদেশে অনেকদিন ধরে স্বৈরতন্ত্রের উপস্থিতি। পার্বত্য চট্টগ্রামে যে ইনার লাইন রেগুলেশন ছিল সেটা ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান সরকার বন্ধ করে দেয়। তারপর থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে কাপ্তাই বাঁধ স্থাপনের মাধ্যমে সেখানকার জুম্ম আদিবাসীদের সুখকে হরণ করার মধ্য দিয়ে এখনও পুরো পার্বত্য চট্টগ্রাম জুড়ে এখন একটি নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা চালু রেখেছে এই রাষ্ট্র। চুক্তি বাস্তবায়ন হচ্ছে তার অন্যতম একটি কারণ হল বাঙালীদের মন-মানসিকতা। বাংলাদেশে কয়েকটি রাজনৈতিক দল ছাড়া অনেক দলই পার্বত্য চুক্তি ও আদিবাসীদের অধিকার বিষয়ে সচেতন না।
স্বাগত বক্তব্যে ডা. গজেন্দ্রনাথ মাহাতো বলেন, ১৯৭৬-১৯৯৭ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ফসল পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি। কিন্তু বর্তমানে সেই চুক্তিকে ভুলিয়ে দিতে চায় এই রাষ্ট্র। পার্বত্য চট্টগ্রামকে সেনা শাসনের হাতে না রেখে সিভিল প্রশাসনের হাতে তুলে দিতে হবে। আমাদেরকে আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে হবে। কল্পনা চাকমার অপহরণকারীদেরকে যথাযথ শাস্তির আওতায় আনতে হবে। বর্তমানে গুম, খুন সম্পর্কিয় যে কমিশন করা হয়েছে সেই কমিশনের কোনো কাজ আমরা দেখতে পাচ্ছি না। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে গঠিত সরকারও জনগণের সরকার হিসেবে হয়ে উঠতে পারছে না।
তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণাঙ্গ ও যথাযথ বাস্তবায়নের জোর দাবি জানান।
সভাপতির বক্তব্যে অজয় এ মৃ বলেন, আদিবাসী অধিকারের আন্দোনের সাথে আদিবাসীবান্ধব অনেক মেইনস্ট্রিমের মানুষ আছে বিধায় আমাদের অধিকারের আন্দোলনগুলো এখনও অনেক জোরালো হয়।
তিনি তাদেরকে ধন্যবাদ জানিয়ে ভবিষ্যতে আন্দোলনে আরও জোরালোভাবে সাথে থাকার জন্য প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে আদিবাসীদের বিষয়ে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক হওয়ার আহ্বান জানান।