হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির প্রতিবেদন
এপ্রিল মাসেও মানবাধিকার পরিস্থিতির আশানুরূপ উন্নতি হয়নি

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৬ মে ২০২৫, ০৭:৩৯ পিএম

২০২৫ সালের এপ্রিল মাসেও মানবাধিকার পরিস্থিতির আশানুরূপ উন্নতি হয়নি। বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ এবং হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসের মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। আজ মঙ্গলবার এইচআরএসএসের নির্বাহী পরিচালক ইজাজুল ইসলাম এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানায়।
বিবৃতিতে বলা হয়, ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসেও মানবাধিকার পরিস্থিতির আশানুরূপ উন্নতি হয়নি। এই মাসের মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, রাজনৈতিক সহিংসতায় মৃত্যু, নারী নিপীড়ন ও ধর্ষণ, শিশু নির্যাতন, গণপিটুনিতে নির্যাতন ও হত্যা, শ্রমিক নির্যাতন, সাংবাদিকদের ওপর হামলা, বাক স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ, কারাগারে ও হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। এই মাসে চাঁদাবাজি, চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, হত্যাসহ বেশ কিছু সামাজিক অপরাধ ঘটেছে যা জনমনে ভয় ও আতঙ্ক তৈরি করেছে।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, থানা ও পুলিশের ওপর হামলা করে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্ট আসামিদের ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা এবং আদালত ও কারা ফটকে আসামীর উপর হামলার মত ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে। এছাড়াও, বাংলাদেশ ভারত সীমান্তে নিরীহ বাংলাদেশি হত্যা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং মিয়ানমার সীমান্তে সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির অপতৎপরতা মানবাধিকার পরিস্থিতির বিষয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
এপ্রিল মাসে কমপক্ষে ৭৮ টি “রাজনৈতিক সহিংসতার” ঘটনায় নিহত হয়েছেন অন্তত ১১ জন এবং আহত হয়েছেন কমপক্ষে ৭২৭ জন। আধিপত্য বিস্তার, রাজনৈতিক প্রতিশোধ পরায়ণতা, চাঁদাবাজি ও বিভিন্ন স্থাপনা দখল কেন্দ্রিক অধিকাংশ সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এপ্রিল মাসে রাজনৈতিক সহিংসতার সংখ্যা মার্চ মাসের তুলনায় কিছুটা কমেছে। গত মার্চ মাসে ৯৭ টি “রাজনৈতিক সহিংসতার” ঘটনায় নিহত হয়েছিলেন ২৩ জন এবং আহত হয়েছিলেন ৭৩৩ জন।
এপ্রিল মাসে সহিংসতার ৭৮টি ঘটনার মধ্যে বিএনপির অন্তর্কোন্দলে ৩৯টি ঘটনায় আহত হয়েছেন ৪৬৭ জন ও নিহত ৭ জন, ২৫টি বিএনপি-আওয়ামী লীগের মধ্যে সংঘর্ষে আহত হয়েছেন ২০২ জন ও নিহত ৩ জন, ২টি বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে সংঘর্ষে আহত হয়েছেন ৩ জন, ৩টি বিএনপি-এনসিপির মধ্যে সংঘর্ষে আহত হয়েছেন ৬ জন, ৩টি আওয়ামী লীগ-জামায়াতের মধ্যে সংঘর্ষে আহত হয়েছেন ৪ জন, এনসিপি-আওয়ামী লীগের মধ্যে সংঘর্ষের ৪টি ঘটনায় আহত হয়েছেন ৫ জন, আওয়ামী লীগের অন্তর্কোন্দলে ৩টি ঘটনায় আহত হয়েছেন ৪০ জন ও নিহত ১ জন, এবং ৩টি ঘটনা ঘটেছে বিভিন্ন দলের মধ্যে। নিহত ১১ জনের মধ্যে বিএনপির ৮ জন, ও আওয়ামী লীগের ৩ জন।
৭৮টি সহিংসতার ঘটনার ৬৯ টিই ঘটেছে বিএনপির অন্তর্কোন্দলে ও বিএনপির সাথে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মধ্যে। গত মার্চ মাসের তুলনায় এপ্রিল মাসে বিএনপির সাথে আওয়ামী লীগের সংঘর্ষ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং জামায়াত ও এনসিপির সাথে সংঘর্ষ কমেছে।
এর পাশাপাশি দুষ্কৃতকারীদের দ্বারা রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা-কর্মীদের ওপর হামলার অন্তত ২২টি ঘটনা ঘটেছে। এসকল হামলায় আওয়ামী লীগের ৫ জন, বিএনপির ৯ জন, ও জামায়াতের ১ জনসহ অন্তত ১৬ জন ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। এছাড়াও এ মাসে রাজনৈতিক সহিংসতায় ১০ জনের বেশি গুলিবিদ্ধ, শতাধিক বাড়ি-ঘর, যানবাহন, ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। সেইসাথে বিএনপির নিজেদের কর্মীদের ও প্রতিপক্ষের দ্বারা অন্তত টি রাজনৈতিক কার্যালয় হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে।
এদিকে এপ্রিল মাসে অন্তত ২৯টি ঘটনায় কমপক্ষে ৩৮ জন সাংবাদিক নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়েছেন। এ সকল ঘটনায় আহত হয়েছেন অন্ততপক্ষে ১৫ জন, লাঞ্চনার শিকার হয়েছেন ৭ জন, হুমকির সম্মুখীন হয়েছেন ৫ জন ও গ্রেফতার হয়েছেন ৩ জন। এছাড়াও ২ টি মামলায় ৮ জন সাংবাদিককে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এ মাসে সাইবার নিরাপত্তা আইন ২০২৩ এর অধীনে দায়ের করা ৩ টি মামলায় গ্রেফতার হয়েছেন ২ জন এবং অভিযুক্ত করা হয়েছে ৫ জনকে ।
এছাড়া এপ্রিল মাসে গণপিটুনির ২২টি ঘটনায় নিহত হয়েছেন কমপক্ষে ১২ জন এবং আহত হয়েছেন অন্তত ২১ জন। বরিশালের উজিরপুর উপজেলায় ‘অনৈতিক সম্পর্কের’ অভিযোগ এনে যুবক-যুবতীকে বৈদ্যুতিক খুঁটিতে বেঁধে নির্যাতন করা হয়। রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরের সিলেট্যা বাজার এলাকায় গণপিটুনিতে নাদিম (৩৫) ও মাসুদ (২৯) নামে দুইজন নিহত এবং সোহাগ (২৮) নামে একজন আহত হয়েছেন। ধর্ষণের মিথ্যে গুজব ছড়িয়ে ডোমারের গোমনাতী মডেল একাডেমি নামের একটি কিন্ডারগার্টেনের অধ্যক্ষ মিজান আহমেদকে (৪২) বস্ত্রহরণ, মাথার চুল কেটে রঙ মাখিয়ে গলায় জুতার মালা পরিয়ে বেধড়ক গণপিটুনির মাধ্যমে হত্যার চেষ্টা করা হয়। ওমরাহ শেষে পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে আসা নোয়াখালীর যুবলীগ নেতা আবদুল কাদের মিলনকে (৩৫) গণপিটুনির মাধ্যমে হত্যা করা হয়।
এপ্রিল মাসে ভারত- বাংলাদেশ সীমান্তে ১০ টি হামলার ঘটনায় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ ) কর্তৃক ৫ জন বাংলাদেশি নিহত ও ৫ জন আহত হয়েছেন এবং গ্রেফতার করা হয়েছে ৩ জনকে। নিহত ৫ জনের মধ্যে ২ জনকে পিটিয়ে এবং ৩ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এছাড়াও সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার সীমান্তে খাসিয়াদের গুলিতে কুটি মিয়া (৫০) নামে এক বাংলাদেশি শ্রমিক নিহত হয়েছেন।
বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং সীমান্তে আরাকান আর্মির পুঁতে রাখা স্থলমাইন বিস্ফোরণে মোহাম্মদ ফিরোজ ওরফে ফিরোজ আলম (৩০) নামে এক বাংলাদেশি জেলের ডান পা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এছাড়া কক্সবাজারের টেকনাফ-সেন্টমার্টিনের কাছাকাছি সাগর থেকে দুটি মাছ ধরার ট্রলারসহ ১১ জেলেকে মিয়ানমারের সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির (এএ) অপহরণ করেছে।
এপ্রিল মাসে কমপক্ষে ১৯৬ জন নারী ও কন্যা শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৮৮ জন, যাদের মধ্যে ৫২ (৫৯%) জন ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু। এটা অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয় যে, ১৯ জন নারী ও কন্যা শিশু গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন এবং ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৬ জনকে ।
এ মাসে ২৪টি শ্রমিক নির্যাতনের ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৫ জন এবং আহত হয়েছেন কমপক্ষে ১১৪ জন শ্রমিক। এ মাসে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নামে কমপক্ষে ১৬ টি মামলা হয়েছে। এ সকল মামলায় ১০৩১ জনের নাম উল্লেখ করে এবং ১৮১৬ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে।
এপ্রিল মাসে সারাদেশে কারাগারে কমপক্ষে ৯ জন আসামি মারা গিয়েছেন। ৯ জনের মধ্যে ২ জন কয়েদি ও ৭ জন হাজতি।