এএফপির প্রতিবেদন
বাংলাদেশের বিপ্লবী শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন ফিকে হয়েছে বেকারত্বে

ছবি: এএফপি
বন্দুকের সামনে বুক পেতে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের স্বৈরাচারী সরকারকে উৎখাত করেছে শিক্ষার্থী। কিন্তু এই বিপ্লবের ছয় মাস পার হওয়ার পরই অনেক শিক্ষার্থী বলছেন, বাধার দেয়াল ভেঙে সামনে এগিয়ে যাওয়ার চেয়ে যেন একটি চাকরি খুঁজে পাওয়া আরও কঠিন। বার্তা সংস্থা এএফির এক প্রতিবেদনে এমনটাই বলা হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ রিজওয়ান চৌধুরীর মতো যুবকের অসংখ্য সুযোগের স্বপ্ন এখন অনেকটাই ম্লান। তিনি বলেন, শান্তিতে নোবেল পুরস্কারজয়ী ড. মোহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকরের পক্ষ থেকে তেমন কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখতে পাচ্ছেন না।
২৫ বছর বয়সী এই শিক্ষার্থী স্বৈরাচারী সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। যে তীব্র আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন। রিজওয়ান চৌধুরী বলেন, এখন পর্যন্ত সরকারকে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখছি না।
গত বছরের সরকারবিরোধী সেই আন্দোলনের অন্যতম প্রধান কারণই ছিল বেকারত্ব। তবে বিপ্লবের পর এই সমস্যার সমাধান হয়নি। বরং আরও প্রকট হয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরের শেষে ১৭ কোটি জনসংখ্যার দেশে চাকরিপ্রত্যাশীর সংখ্যা ২৬ লাখ ৬০ হাজারে পৌঁছেছে। আগের বছরে ২৪ লাখ ৯০ হাজারের তুলনায় যা ছয় শতাংশ বেশি।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশকে সতর্ক করে বলেছিল, দেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রম ‘গুরুতরভাবে ধীরগতিতে’ চলছে, যেখানে মুদ্রাস্ফীতি দুই সংখ্যার ঘরেই অবস্থান করছে। আর রাজস্ব আয় কমে যাওয়ার সঙ্গে ব্যয় বৃদ্ধির চাপ তো ছিলই। এ অবস্থায় শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির উচ্ছ্বাস এখন অনেকের কাছে ফিকে হয়ে আসছে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক শেষ করা রিজওয়ান চৌধুরী বলেন, যদিও ইউনূস তার মন্ত্রিসভায় ছাত্র নেতাদের রেখেছেন। তারপরও তিনি মনে করেন তাদের দাবিগুলো উপেক্ষা করা হচ্ছে। রিজওয়ান বলেন, প্রশাসনে আমাদের থাকার পরও আমি নিশ্চিত না আমাদের কথাগুলো শোনা হচ্ছে কিনা।
সাহিত্যে স্নাতক করা ৩১ বছর বয়সী শুক্কুর আলী বৃদ্ধ ও অসুস্থ বাবা-মাকে সাহায্য করার অড জব করছেন। শুক্কুর আলী এএফপিকে বলেন, ন্যূনতম খরচ মেটানোর জন্য আমি এসব করছি।
সংবাদপত্রে চাকরি বিজ্ঞাপন বন্ধ হয়ে গেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমি আগে কেবল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ব্যাংকে ভালো পোস্টে আবেদন করতাম। কিন্তু সেখানে ব্যর্থ হই। এখন যেকোনো চাকরিই আমার জন্য দরকারি। আমি শুধু একটা চাকরি চাই।
বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ও অর্থনীতি বিশ্লেষক জাহিদ হোসেন বলেন, কর্মক্ষম শ্রমশক্তির প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ব্যয় মেটানোর জন্য যে চাকরি পাচ্ছেন তাই করে যাচ্ছেন।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের অর্থনীতি নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পায়। এর মূল কারণ ছিল দেশটির টেক্সটাইল শিল্প বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক হিসেবে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের ব্যবসায় বিশ্বব্যাপী ব্র্যান্ড তৈরি করে।
কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতকদের জন্য জনাকীর্ণ পোশাক কারখানার বাইরে চাকরির সংখ্যা অল্পই। বিবিএসের পরিসংখ্যান অনুসারে, কর্মহীনদের মধ্যে ৮৭ শতাংশই শিক্ষিত বাংলাদেশি।
তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বলছে, তারা এই সমস্যা সমাধানে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছে। এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, কর বৃদ্ধি করা হয়েছে। এই কর সংগ্রহ করে সরকার জনখাতে বিনিয়োগ করবে। এতে বিপুল সংখ্যক চাকরির সুযোগ সৃষ্টি হবে।
তিনি আরও বলেন, আগের সরকার ডুবন্ত অর্থনীতি রেখে গেছে। তাই রাজস্ব সংগ্রহ বৃদ্ধি নিশ্চিত করা অগ্রাধিকারে আছে।
কিন্তু ৮৪ বছর বয়সী ক্ষুদ্রঋণের পথিকৃৎ ইউনূসও এই বছর অথবা ২০২৬ সালের প্রথম দিকে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনের আগে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান পুনরুদ্ধার ‘অত্যন্ত কঠিন’ চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন। এই সংস্কারের মধ্যে রয়েছে স্বৈরাচারে ফিরে আসা রোধে সংবিধান এবং জনপ্রশাসনের সংস্কার।
জাহিদ হোসেন বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার তার আগের সরকারের রেখে যাওয়া জগাখিচুড়ি সামলাতে ব্যস্ত। তরুণদের সহায়তার জন্য তারা কেবল ‘বিক্ষিপ্ত প্রচেষ্টা’ চালিয়েছে। যেমন ট্রাফিক পুলিশকে সহায়তার জন্য শিক্ষার্থীদের নিয়োগ করা।
তিনি বলেন, প্রশাসন পূর্ণ গতিতে কাজ করছে না। আমি তাদের ১০০-তে ৫০ রেটিং দেব।
অনলাইন চাকরির প্ল্যাটফর্ম বিডিজবসের প্রধান ফাহিম মাশরুর বলেন, সরকারি খাত প্রতি বছর সর্বোচ্চ ২০ হাজার থেকে ২৫ হাজার গ্রাজুয়েট নিয়োগ করতে পারে। যেখানে প্রতি বছর প্রায় ৭ লাখ শিক্ষার্থী স্নাতক পাস করে বের হন। আর বেসরকারি খাত চাকরি দিতে পারে ৮৫ শতাংশ গ্রাজুয়েটকে। তবে সেখানেও আশার আলো কম। ৫ আগস্ট থেকে সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতে নিয়োগ ধীরগতিতে চলছে।
আর এই অস্থিরতা বিনিয়োগকারীদের ভীত করে তুলেছে। বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে, ২০২৪ সালের জুলাই থেকে নভেম্বরে বিদেশি বিনিয়োগ ছিল ১৭৭ মিলিয়ন ডলার। যা আগের বছরের একই সময়ে হাসিনার কঠোর শাসনামলে ৬১৪ মিলিয়ন ডলারের এক তৃতীয়াংশেরও কম।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেন, তরুণ চাকরিপ্রত্যাশীদের সহায়তায় বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হবে সরকারকে। এতে তরুণদের ব্যবসা শুরুর জন্য ঋণ প্রকল্প থাকতে হবে।
ফিন্যান্সে স্নাতক শেষ করা সুবীর রায়ের মতো কাউকে কাউকে আবার সরকারি চাকরিতে মনোনীত করা হয়েছিল। কিন্তু কোনো কারণ ছাড়াই তা আবার বাতিলও করা হয়েছে। তিনি বলেন, ইতোমধ্যেই অনেক দেরি হয়ে গেছে। আমার বাবা আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানোর জন্য ছোট একখন্ড জমি বিক্রি করেছিলেন…এখন আমি খালি হাতে বাড়ি ফিরছি। বাবার সঙ্গে আমি ধানক্ষেতে যোগ দেব।