মিথ্যা তথ্যে হাসিনাসহ ১৬০ জনের নামে ফোরকান হত্যা মামলা, বাবার অভিযোগ
বগুড়া প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২২ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৩৪ পিএম
ফোরকান আলী। ছবি: সংগৃহীত
বগুড়ায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, বোন শেখ রেহানাসহ ১৬০ জনের নাম উল্লেখ করে আদালতে করা যুবদল নেতা ফোরকান আলী হত্যা মামলার তদন্ত কার্যক্রম স্থগিতের জন্য পুলিশ সুপারের কাছে আবেদন করেছেন তার বাবা আবদুল কুদ্দুস। সেই সঙ্গে এই হত্যা মামলা প্রত্যাহারের জন্য আগামী রবিবার বগুড়ার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (শাজাহানপুর) আমলি আদালতে আবেদন করবেন বলে জানিয়েছেন তিনি।
আবদুল কুদ্দুস অভিযোগ করেছেন, তিনি বা তার পরিবারের কেউ এই হত্যা মামলা করেননি। মামলাটি অন্য একজন মিথ্যা তথ্য দিয়ে করেছেন। সেই সঙ্গে সেই বাদী ও তার সাক্ষীরা এই মামলায় বিভিন্নজনকে আসামি করার ভয় দেখিয়ে চাঁদাবাজি করছেন। মামলায় ফোরকানকে ‘গুলি করে হত্যা’র কথা বলা হলেও গুলির কোনো ঘটনা ঘটেনি বলে দাবি করেছেন তার বাবা।
তিনি বলেন, ফোরকান ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিলেন।
আবদুল কুদ্দুস বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার খোট্টাপাড়া ইউনিয়নের ঘাসিড়া সুফিপাড়া গ্রামের বাসিন্দা। তার ছেলে নিহত ফোরকান আলী ওই ইউনিয়ন যুবদলের আহ্বায়ক ছিলেন। সেই সঙ্গে বেসরকারি সংস্থা টিএমএসএসের একটি কারখানার কর্মী ছিলেন।
গত বছরের ৩ ডিসেম্বর সকালে শাজাহানপুরের সাজাপুর এলাকায় ঢাকা-রংপুর মহাসড়কে বিএনপির অবরোধের সমর্থনে মিছিল বের করা হয়। ওই মিছিলে খোট্টাপাড়া ইউনিয়ন যুবদলের আহ্বায়ক ফোরকান আলীও অংশ নেন। এ সময় পুলিশ ও র্যাবের টহল দল অবরোধকারীদের ধাওয়া দেয়। ফোরকান আলী মোটরসাইকেলে পালানোর সময় সাজাপুর-ফুলতলা মাদ্রাসার পেছনের সড়কে গিয়ে পড়ে যান। স্থানীয় লোকজন উদ্ধার করে বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকেরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
এ ঘটনার ১১ মাস পর ১ নভেম্বর বগুড়ার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (শাজাহানপুর) আমলি আদালতে শাজাহানপুর উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক ইউনুস আলী বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা করেন। মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার ছেলে সাবেক তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়, শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানা, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি সাজেদুর রহমান, উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা নুরুজ্জামানসহ ১৬০ জনের নাম উল্লেখ এবং অজ্ঞাতনামা আরও ৪০০-৫০০ জনকে আসামি করা হয়। মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে ফোরকানকে গুলি করে হত্যার অভিযোগ আনা হয়।
মামলাটি মিথ্যা তথ্য দিয়ে করা হয়েছে বলে ফোরকানের বাবা আবদুল কুদ্দুস বগুড়ার পুলিশ সুপারের কাছে ৫ নভেম্বর লিখিত অভিযোগ করেছেন। লিখিত অভিযোগে তিনি বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ধাওয়ায় ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে তার ছেলে ফোরকানের হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু হয়েছে। এ মৃত্যুতে কারও প্রতি অভিযোগ না থাকায় ময়নাতদন্ত ছাড়াই ফোরকানকে দাফন করা হয়। অথচ পরিবারকে না জানিয়ে বা কোনো প্রকার আলাপ–আলোচনা না করেই ইউনুস আলী চাঁদাবাজির উদ্দেশ্যে আদালতে হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। আদালতে মামলা দায়েরের পর থেকেই বাদী ইউনুস আলী আসামিদের কাছ থেকে চাঁদা দাবি, এমনকি অজ্ঞাতনামা আসামি হিসেবে অনেককে মামলায় ফাঁসানোর ভয়ভীতি দেখিয়ে টাকা আদায় করছেন।
হৃদ্রোগে মৃত্যুকে গুলি করে হত্যা বলে চালিয়ে দিয়ে সাজানো মামলার তদন্ত কার্যক্রম স্থগিত এবং চাঁদাবাজি বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আবদুল কুদ্দুস পুলিশ সুপারের কাছে আবেদন জানান।
আজ শুক্রবার (২২ নভেম্বর) সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় তিনি সংবাদমাধ্যমকে জানান, তিনি আদালতে গিয়েছিলেন। আদালত ফোরকানের হৃদ্রোগে মৃত্যুর কাগজপত্র চেয়েছেন। সেসব কাগজপত্র গুছিয়ে রোববার শাজাহানপুর আমলি আদালতে তিনি মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করবেন।
ফোরকানের ছোট ভাই ওমর ফারুক জানান, তার ভাই খোট্টাপাড়া ইউনিয়ন যুবদলের আহ্বায়ক ছিলেন। হৃদ্রোগে মৃত্যু হওয়ায় ময়নাতদন্ত ছাড়াই পারিবারিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী লাশ দাফন করা হয়েছে। মামলার বাদী ইউনুস আলী তাদের কোনো আত্মীয় নন, সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে সব সময় তার ভাইয়ের বিরোধিতা করেছেন তিনি।
ওমর ফারুক বলেন, আমার ভাইকে হত্যা করা হলে পারিবারিকভাবে আমরাই মামলা দায়ের করতাম। অথচ পরিবারের সঙ্গে কোনো প্রকার আলাপ-আলোচনা না করে বা ন্যূনতম জানানোর প্রয়োজন মনে না করেই ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সুযোগে ইউনুস আলী বিভিন্ন ব্যক্তির নামে ঢালাও মামলা করেছেন। গুলির কোনো ঘটনা না ঘটলেও আমার ভাইকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে বলে মামলায় মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন। মামলাকে পুঁজি করে তিনি এবং মামলার সাক্ষী শফিকুল ইসলাম ও জিল্লুর রহমান এখন চাঁদাবাজি করছেন। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া ও মামলার তদন্ত কার্যক্রম স্থগিতের জন্য আমার বাবা পুলিশ সুপারের কাছে আবেদন করেছেন।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে বগুড়ার পুলিশ সুপার জেদান আল মুসা সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ফোরকানকে গুলি করে হত্যার অভিযোগ এনে আদালতে মামলা হয়েছে। আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী মামলার পরবর্তী কার্যক্রম চলমান আছে। ফোরকানের বাবা আবদুল কুদ্দুস মামলার তদন্ত কার্যক্রম স্থগিতের একটি আবেদন দিয়েছেন। যেহেতু আদালতে মামলা হয়েছে, এখন তদন্ত কার্যক্রম স্থগিতের আদেশও আদালত থেকেই আসতে হবে। মামলার বিষয়ে কোনো আপত্তি থাকলে আবদুল কুদ্দুসকে আদালতে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া চাঁদাবাজির কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে শাজাহানপুর থানায় মামলা দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে মামলার বাদী ও শাজাহানপুর উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক ইউনুস আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। পরিবারকে না জানিয়ে আদালতে ফোরকান হত্যা মামলা দায়ের প্রসঙ্গে তিনি বলেন,দলীয় সিদ্ধান্তেই এই মামলা দায়ের করা হয়েছে। দলীয় নেতাদের নির্দেশ মেনে আমি এই মামলার বাদী হয়েছি।
পরিবারের মতামত নিয়েই মামলা দায়ের করা হয়েছে দাবি করে ইউনুস আলী আরও বলেন, কারও চাপে পড়ে হয়তো এখন ফোরকানের বাবা পুলিশ সুপারের কাছে তদন্ত কার্যক্রম স্থগিতের আবেদন দিয়েছেন। তা ছাড়া চাঁদাবাজির অভিযোগ ভিত্তিহীন।
চাঁদাবাজির অভিযোগ প্রসঙ্গে মামলাটির সাক্ষী ও ইউনিয়ন বিএনপির সদস্য শফিকুল ইসলাম বলেন, অবরোধের মিছিলে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হামলায় যুবদল নেতা ফোরকানের মৃত্যু হয়েছে। গুলিতে মৃত্যু হয়নি। মামলায় সাক্ষ্য দেওয়ার প্রয়োজন হলে একই সাক্ষ্য দেব। মামলাকে পুঁজি করে কারও কাছ থেকে চাঁদা চাওয়ার অভিযোগ সত্য নয়।