পার্বত্যাঞ্চলের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণসহ স্থানীয়দের সঙ্গে মতবিনিময় করতে গিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের তিন উপদেষ্টা।
আজ শনিবার (২১ সেপ্টেম্বর) সকালে তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে হেলিকপ্টারে করে রওনা হয়ে বেলা ১১টায় রাঙামাটি গিয়েছেন তিন উপদেষ্টা। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ।
তারা রাঙামাটির রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলাসংক্রান্ত বিষয়ে মতবিনিময় করবেন। বিকালে খাগড়াছড়ি গিয়ে একই বিষয়ে মতবিনিময়সহ আলোচনা করবেন।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বৃহস্পতিবার খাগড়াছড়ি ও শুক্রবার রাঙামাটিতে সৃষ্ট সমস্যা নিরসনে আন্তরিকভাবে কাজ করছে সরকার। ১৮ সেপ্টেম্বর এক ব্যক্তিকে পিটুনি ও পরে তার মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে চলমান হামলা, আক্রমণ ও প্রাণহানির ঘটনায় সরকার গভীরভাবে দুঃখিত এবং ব্যথিত। সরকারের পক্ষ থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সর্বোচ্চ সংযম দেখাতে এবং পার্বত্য তিন জেলায় বসবাসকারী সব মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সেখানে শান্তি, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি নিশ্চিত করতে সরকার বদ্ধপরিকর বলে বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়।
পার্বত্য চট্টগ্রামের সড়ক ও নৌপথ ৭২ ঘণ্টা অবরোধ
খাগড়াছড়িতে জুম্মদের ওপর হামলার প্রতিবাদে পার্বত্য চট্টগ্রামের সড়ক ও নৌপথ ৭২ ঘণ্টা অবরোধের ডাক দিয়েছে ঢাকায় বসবাসকারী জুম্ম জনতা।
গতকাল শুক্রবার (২০ সেপ্টেম্বর) ঢাকায় বসবাসকারী জুম্ম জনতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ থেকে এই কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
খাগড়াছড়িতে সাম্প্রতিক অগ্নিসংযোগ ও নির্বিচারে সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে এই বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। হত্যাকাণ্ডের বিচারও দাবি করেন বিক্ষুব্ধরা।
বিক্ষোভে আদিবাসী শিক্ষার্থী এবং নাগরিকরা ১৯ সেপ্টেম্বর দীঘিনালায় অগ্নিসংযোগের ঘটনার পাশাপাশি এই অঞ্চলে কথিত সামরিক সহিংসতার নিন্দা জানায়। বিক্ষোভকারীরা দায়ীদের শাস্তির আহ্বান জানিয়েছে এবং সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বৃদ্ধির বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়িতে গণপিটুনির হাত থেকে বাঁচতে পালাতে গিয়ে বৈদ্যুতিক খুঁটির সঙ্গে ধাক্কা লেগে স্থানীয় এক যুবকের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় পানখাইয়াপাড়া এলাকায় সেটেলার বাঙালিরা জুম্মদের ধাওয়া করলে অশান্তির সৃষ্টি হয়। পরের দিন, একদল বসতি স্থাপনকারী বাঙালি দীঘিনালায় জুম্ম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে স্লোগান দিয়ে মিছিল করে, যার ফলে সংঘর্ষ হয় এবং জুম্মের মালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।
আয়োজকদের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, অন্তত ৩০টি বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে।
ওই রাতেই খাগড়াছড়ির একাধিক এলাকায় সামরিক বাহিনী এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে জামতলীর জুনান চাকমা ও পল্টনজয় পাড়ার রুবেল চাকমা নামে দুই জুম্মকে হত্যা করে। সহিংসতায় অন্তত ৪০ জন আহত হয়েছেন, অনেকে এখনও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বলে জানিয়েছেন তারা।
বিক্ষোভ চলাকালে রাঙামাটির বিভিন্ন স্থানে আদিবাসীদের ওপর বসতি স্থাপনকারী বাঙালিদের আরও হামলার নিন্দা জানান বিক্ষোভকারীরা। তারা বনরূপা মৈত্রী মঠসহ বাড়িঘর ও ধর্মীয় স্থাপনা ভাঙচুর ও লুটপাটের কথা বলা হয়। অনিক কুমার চাকমা নামে এক আদিবাসী নিহত হন বলেও দাবি করা হয়।
সমাবেশে বক্তব্য দেন ও অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী নাবাংশু চাকমা ও সঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষার্থী সাতেজ চাকমা। অন্যান্য বক্তাদের মধ্যে আদিবাসী ছাত্র সংগঠন, শ্রমিক সংগঠন এবং মানবাধিকার গোষ্ঠীর নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
নাবাংশু চাকমা পার্বত্য চট্টগ্রামে সড়ক ও নৌপথ অবরোধের ঘোষণা দিয়ে সহিংসতায় জড়িতদের বিচারের দাবিতে ৭২ ঘণ্টা সড়ক ও নৌপথ অবরোধের ঘোষণা দেন।
বিক্ষোভকারীরা নিম্নলিখিত দাবিগুলো পেশ করেন:
১. দীঘিনালায় সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্তসহ তিন পার্বত্য জেলার জুম্মবাসীর জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
২. খাগড়াছড়ি ও দীঘিনালার ঘটনার বিষয়ে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে তদন্ত শুরু করে দোষীদের শাস্তি দিতে হবে।
৩. সামরিক বাহিনীর গুলিতে নিহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া এবং আহতদের চিকিৎসা নিশ্চিত করা।
৪. ক্ষতিগ্রস্ত বৌদ্ধ বিহারগুলো পুনঃনির্মাণ এবং বিধ্বস্ত দোকান ও ঘরবাড়ির মালিকদের পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়া।
৫. সহিংসতায় জড়িত সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের বরখাস্ত ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ।
৬. শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সামরিক ও বসতি স্থাপনকারী বাঙালিদের প্রত্যাহার করা।
৭. পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন এবং চলমান সংঘাতের রাজনৈতিক সমাধান হিসেবে স্বায়ত্তশাসন প্রদান।
আন্দোলনকারীরা আশা করেন, আদিবাসী জুম্ম জনগণ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের বৃহত্তর আন্দোলনে সম্পৃক্ত হবে। তবে বিক্ষোভকারীরা বলছেন, এর পরিবর্তে তারা সহিংসতা ও নিপীড়নের শিকার হয়েছেন, যার ফলে অনেকে নিরাপত্তার জন্য জঙ্গলে তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন।