Logo
Logo
×

অনুসন্ধান

তদন্তকারীরা এস আলমের দুর্নীতির নতুন ছাপ খুঁজে পেলেন আট দেশে

জুলকারনাইন সায়ের

জুলকারনাইন সায়ের

প্রকাশ: ১৩ আগস্ট ২০২৫, ১১:৪০ এএম

তদন্তকারীরা এস আলমের দুর্নীতির নতুন ছাপ খুঁজে পেলেন আট দেশে

বছরের পর বছর ধরে মোহাম্মদ সাইফুল আলম, এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান, এবং তার পরিবারের নেতৃত্বে দুর্নীতি ও অর্থপাচারের যে বিশাল জাল বিস্তৃত হয়েছে, তা বাংলাদেশে এক প্রকার ওপেন সিক্রেট হিসেবেই প্রচলিত ছিল। চট্টগ্রাভিত্তিক এই বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী দেশের ভেতরে ও বাইরে যেভাবে হঠাৎ করে বিপুল সম্পদের মালিক হয়ে উঠেছে, তা নিয়ে নানা প্রশ্ন বহুদিন ধরেই ঘুরপাক খাচ্ছিল। কিন্তু গত দুই বছরে, বিশেষ করে শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসনের পতনের পর, এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার কাজ কিছুটা গতি পায়।

নতুন যে সব তথ্য সামনে এসেছে, তা পূর্বের ধারণাকেও ছাপিয়ে গেছে। যে মাত্রায় এই সম্পদ পাচার ও দুর্নীতি চলেছে, তা একে কেবল বাংলাদেশের ইতিহাসেই নয়, আধুনিক বিশ্বের অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারির ইতিহাসেও একটি দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড় করায়। কমপক্ষে নয়টি বিদেশি আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি একটি অগ্রগতি রিপোর্টে বলা হয়েছে, এস আলম গ্রুপ প্রায় ২২৩,৮৫৫ কোটি টাকা, অর্থাৎ প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার করেছে। এই বিপুল অর্থ পাচারের কাজটি হয়েছে অন্তত ৪৭০টি শেল কোম্পানির মাধ্যমে, যেগুলো বিশ্বের ৯টি দেশে গড়ে তোলা হয়।

এই টাকা দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের প্রায় ৪ শতাংশের সমান, যা এই ঘটনার ব্যাপকতা ও ভয়াবহতা বোঝাতে যথেষ্ট। এত বড় একটি অর্থনৈতিক অপরাধ কীভাবে দীর্ঘদিন ধরা ছাড়াই চলে গেছে, তা নিয়ে দেশি-বিদেশি অর্থনৈতিক মহলে বিস্ময়ের সৃষ্টি হয়েছে।

সাধারণত বাংলাদেশ ফিনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) বিদেশে নাগরিকদের সম্পদের অনুসন্ধান করতে গেলে একটি নির্দিষ্ট দেশের তালিকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। সেই তালিকায় থাকে অস্ট্রেলিয়া, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, হংকং, থাইল্যান্ড এবং সুইজারল্যান্ডের মতো দেশগুলো।

কিন্তু এস আলম গ্রুপ সংক্রান্ত অনুসন্ধানে সেই চিরাচরিত প্রথা ভেঙে ফেলা হয়। বিশেষ পর্যালোচনা কমিটির সদস্য মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেনের নেতৃত্বে তদন্তকারীরা এই প্রথমবারের মতো অনুসন্ধানের পরিধি বাড়িয়ে ১১৭টি দেশে সম্পদের খোঁজ করে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এটি ছিল প্রথম একটি বৈশ্বিক সম্পদ অনুসন্ধান, যা আগে কখনো হয়নি।

এই অনুসন্ধান একেবারে ফেলে দেওয়ার মতো কিছু ছিল না। ফল মিলেছে। সাইপ্রাস, অ্যান্টিগা ও বারবুডা, ইতালি, তুরস্ক, সিঙ্গাপুর, জার্সি, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডস, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং আয়ল অফ ম্যান—এই ভিন্ন ভিন্ন দেশে কাজ করা ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটগুলো নিশ্চিত করেছে, এস আলম গ্রুপের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এসব দেশে বিনিয়োগ করেছেন। এর মধ্যে সাতটি দেশ তদন্তকারী দলের হাতে কার্যকর তথ্যও তুলে দিয়েছে। বাকি দুই দেশও তথ্য জমা দিয়েছে, সেগুলো এখন পর্যালোচনার পর্যায়ে।

এই সাতটি দেশের নির্ভরযোগ্য ও সুস্পষ্ট নথির ওপর ভিত্তি করে তদন্তকারীরা বেশ কয়েকটি দেশের আদালত থেকে আদেশ আদায় করেছেন, যা অত্যন্ত জটিল আন্তর্জাতিক আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সম্ভব হয়েছে। এই আদেশগুলো সিঙ্গাপুর, জার্সি, সাইপ্রাস ও ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডসে থাকা ব্যাংক হিসাব ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত তথ্য উন্মোচনের অনুমতি দেয়। বিএফআইইউ-এর একজন কর্মকর্তা বাংলা আউটলুককে জানিয়েছেন, এই আদেশগুলো এখন সংশ্লিষ্ট দেশের কর্তৃপক্ষের হাতে, কার্যকর করার প্রক্রিয়ায় রয়েছে।

ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডসে তদন্তকারীরা ১৯টি কোম্পানির খোঁজ পেয়েছেন, যেগুলোর মালিকানা মোহাম্মদ সাইফুল আলম বা তার পরিবারের সদস্যদের নামে নিবন্ধিত। এসব তথ্য ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের রেকর্ডে অন্তর্ভুক্ত। বাংলা আউটলুক স্বাধীনভাবে এ তথ্য যাচাই করেছে ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডসের অফিসিয়াল কর্পোরেট রেজিস্ট্রির মাধ্যমে। দেখা গেছে, বেশির ভাগ কোম্পানি ২০১৮ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে গঠিত হয়েছে। এ সময়েই এস আলম গ্রুপের ব্যবসা সম্প্রসারণ নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠতে শুরু করে।

সবচেয়ে নতুন একটি কোম্পানির নাম গ্রিনউইচ ইন্টারন্যাশনাল প্রাইভেট লিমিটেড। এটি নিবন্ধিত হয়েছে গত বছরের ২৬ আগস্ট, ঠিক তখনই যখন দেশে শেখ হাসিনার সরকারের পতন ঘটে, এবং নতুন রাজনৈতিক পরিবেশ গড়ে উঠছিল।

এই সব কোম্পানির মধ্যে প্রায় কোনওটিরই রেজিস্ট্রিতে মূলধন বিনিয়োগের তথ্য প্রকাশ করা হয়নি। শুধু একটি কোম্পানির তথ্য পাওয়া গেছে—হ্যাজেল ইন্টারন্যাশনাল প্রাইভেট লিমিটেড। এটি ২০১৯ সালের ১৯ মার্চ মোহাম্মদ সাইফুল আলমের নামে নিবন্ধিত হয়, এবং এতে ঘোষিত মূলধন ছিল তিন লাখ পঞ্চাশ হাজার ডলার।

জার্সি, যেটি ব্রিটিশ ক্রাউন ডিপেন্ডেন্সি এবং অনেক সময় করস্বর্গ হিসেবে পরিচিত, সেখানে সাইফুল আলম ও তার স্ত্রী ফারজানা পারভীন যৌথভাবে ছয়টি জার্সি ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠাতা। এই ট্রাস্টগুলো পরিচালনা করে একটি স্থানীয় ট্রাস্ট কোম্পানি। এই কাঠামোর মাধ্যমে তারা মালিক হয়েছেন দুটি পাঁচতারকা হোটেলের, যেগুলোর সম্মিলিত বাজারমূল্য দাঁড়ায় প্রায় ২১০ মিলিয়ন ডলার।

তদন্তকারীরা তুরস্কে এস আলমের দুই ভাই শাহিদুল আলম ও ওসমান গনির নামে অন্তত দশটি ব্যাংক হিসাবের খোঁজ পেয়েছেন যেগুলো সবই উচ্চমূল্যের বা প্রিমিয়াম অ্যাকাউন্ট হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ। এসব অ্যাকাউন্টে কত টাকা রয়েছে তা তদন্তকারীরা প্রকাশ করেননি, কিন্তু প্রিমিয়াম শ্রেণিভুক্তি থেকেই বোঝা যায়, এই হিসাবগুলোতে বড় অঙ্কের অর্থ রয়েছে।

সংযুক্ত আরব আমিরাতে অনুসন্ধান চালিয়ে দেখা গেছে, এস আলমের জামাতা বেলাল আহমেদের নামে ছয়টি বিলাসবহুল ভিলার মালিকানা রয়েছে যেগুলোর প্রতিটির দাম তিন লাখ পঞ্চাশ হাজার ডলার থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ এক মিলিয়ন আট লাখ ডলার পর্যন্ত। একইসঙ্গে তার নামে দুটি জমির খতিয়ানও পাওয়া গেছে, যেগুলোর সম্মিলিত মূল্য আনুমানিক ৪ মিলিয়ন ডলার।

আইল অফ ম্যানেও আলাদা করে তথ্য এসেছে। সাইফুল আলমের ছেলে আশরাফুল আলম সেখানে ব্রুকউড, ১৫ প্রিন্সেস ড্রাইভ, অকশট, লেদারহেড, কেটি ২২ ০ইউ ঠিকানার একটি সাত মিলিয়ন ডলারের ভিলার মালিক। সম্পত্তিটি ২০২০ সালে কেনা হয় এবং রেকর্ড অনুযায়ী এটি তার মা ফারজানা পারভীনের পক্ষ থেকে উপহার হিসেবে দেওয়া হয়েছে।

অন্যদিকে, বেলাল আহমেদ অ্যান্টিগা ও বারবুডার নাগরিকত্ব কিনেছেন সেই দেশের সিটিজেনশিপ বাই ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রামের মাধ্যমে। তার আবেদনটি প্রক্রিয়াজাত করেছে জেমস অ্যান্ড ম্যাগিনলি লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান, যারা ওই কর্মসূচির অনুমোদিত বিপণন প্রতিনিধি।

এই প্রক্রিয়ার জন্য বেলাল আহমেদ জাতীয় উন্নয়ন তহবিলে এক লাখ ডলার বিনিয়োগ করেন। লেনদেন সংক্রান্ত নথিতে দেখা যায়, এই অর্থ কানাডার অন্টারিওর মিসিসাগায় অবস্থিত টরন্টো-ডমিনিয়ন ব্যাংকে বেলাল আহমেদের নিজস্ব অ্যাকাউন্ট থেকে পাঠানো হয়। মোট ১ লাখ ২৭ হাজার ৪৫ ডলারের ওয়্যার ট্রান্সফার জেমস অ্যান্ড ম্যাগিনলি লিমিটেডের হিসাবে জমা পড়ে, তারাই নাগরিকত্ব কার্যক্রমটি চূড়ান্ত করে।

এস আলমের উত্থান ছিল হঠাৎ, কিন্তু তার ভিত ছিল হুমকির। হিংস্র দখল, অনিয়মিত আর্থিক লেনদেন আর বড় মাপের লুটপাটের ওপর দাঁড়িয়ে আছে তার এই সাম্রাজ্য। এর মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিকর ছিল বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে তার প্রবেশ, যা শুধু ব্যবসায়ী হিসেবেই নয়, গোটা অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ওপর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলেছে।

তার নিয়ন্ত্রণের শুরু হয় ইসলামী ব্যাংক থেকে। এই ব্যাংকটি একসময় দেশের সবচেয়ে বিশ্বস্ত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের তালিকায় থাকত। কিন্তু ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ব্যাংকটিকে রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা শুরু হয়, যা ধীরে ধীরে গোপনে চালিয়ে যাওয়া হয়। এর চূড়ান্ত দখল ঘটে ২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি।

সেদিন সেনা গোয়েন্দাদের সহায়তায় বিশেষ একটি অপারেশনে ব্যাংকের চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালককে নিজ নিজ বাসা থেকে জোর করে তুলে নেওয়া হয়। তাদের ঢাকার ক্যান্টনমেন্টে গোয়েন্দা দপ্তরে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানে তাদের দিয়ে ইস্তফাপত্রে সই করানো হয়। ওইদিনই তাদের স্থানে নতুন ব্যক্তিদের বসিয়ে দেওয়া হয়।

ঠিক একই রকম কৌশলে ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর দখল হয় সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড বা এসআইবিএল। তবে এই ব্যাংক দখলের আগে এস আলম গ্রুপ গোপনে ১৯টি ছদ্ম কোম্পানির নামে ব্যাংকটির প্রায় ৫০ শতাংশ শেয়ার কিনে নেয়। এটি ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯১-এর সরাসরি লঙ্ঘন।

দুর্নীতি দমন কমিশন বা দুদক অনুসন্ধানে পায়, এস আলম এবং তার ঘনিষ্ঠরা আত্মীয়দের নামে ভুয়া ঋণ ও বিনিয়োগ দেখিয়ে ব্যাংক থেকে বড় অঙ্কের টাকা আত্মসাৎ করেছে। দুদকের আশঙ্কা ছিল, তদন্ত শেষ হওয়ার আগেই এস আলম ও তার পরিবার এই টাকাগুলো সরিয়ে ফেলতে পারে কিংবা অন্য কোনোভাবে লুকিয়ে ফেলবে।

এই কারণে আদালতের আদেশে বিএফআইইউ এবং সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোকে এস আলম ও তার পরিবারের সব ব্যাংক হিসাব জব্দ করতে বলা হয়।

২০২৪ সালের আগস্টে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর এস আলম এবং তার স্ত্রী ফারজানা পারভীনের বিরুদ্ধে ১ হাজার ৫৩৯ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের অভিযোগে দুদক দুটি মামলা করে। একইসঙ্গে তাদের দুই ছেলে আহসানুল আলম ও আশরাফুল আলামের বিরুদ্ধেও মামলা হয়। অভিযোগ, তারা ইসলামী ব্যাংক থেকে প্রায় ২ হাজার ২০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে।


Logo

ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন