৫ আগস্ট সকালে শেখ কামালের জন্মদিন উদ্যাপনের কথা ছিল শেখ হাসিনার
ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার আগে ও পরের তথ্যগুলো এখনো পুরোপুরিভাবে জানা সম্ভব হয়নি। তবে প্রত্যক্ষদর্শী, সরকারি দায়িত্ব পালনরত ব্যক্তিবর্গ ও সে সময়ের কাগজপত্রের মাধ্যমে বাংলা আউটলুক নিশ্চিত হতে পেরেছে, শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট সকাল প্রস্তুত রেখেছিলেন তার মৃত ভাই শেখ কামালের জন্মদিন পালনের উদ্দেশ্যে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে সাবেক রাষ্ট্রপতি ও শেখ হাসিনার পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে শেখ কামালও নিহত হন। ৫ আগস্ট ছিল শেখ কামালের জন্মদিন।
৪ আগস্ট স্বাক্ষরিত একটি গোপন নথির সূত্রে জানা গেছে, ৫ আগস্ট সকাল সাড়ে ১০টায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে ক্রিসেন্ট লেক রোড, উড়োজাহাজ ক্রসিং, বিজয় সরণি ক্রসিং, ভিআইপি রোড হয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় (যা এখন প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় হিসেবে পরিচিত) সেখানে যাওয়ার কথা ছিল।
গোপন নথিতে লেখা রয়েছে, "মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আগামী ৫ আগস্ট ২০২৪ সোমবার সকাল ১০ঃ৩০ ঘটিকায় গণভবন হতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের শাপলা হলে "শেখ কামালের জন্মদিন" উপলক্ষে উপস্থিত হবেন।" তার গমনাগমনের ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আদেশ দেওয়া হয়।
নথির ভিত্তিতে বাংলা আউটলুকের সাথে কথা হয় সেদিন দায়িত্ব পালনরত এক কর্মকর্তার সঙ্গে। তিনি বর্তমানে ঢাকায় কাজ করছেন না। তিনি জানান, এই কর্মসূচি পরিবর্তন করা হয়নি। তবে এ কর্মসূচিও পালিত হয়নি।
তিনি বলেন, আমরা মূলত দুই ধরনের কথা শুনতে পাচ্ছিলাম। আমাদের প্রস্তুতি ছিল তিনি কার্যালয়ে যাবেন। কিন্তু হঠাৎই শুনতে পাই তিনি বঙ্গভবনে যাবেন। আমরা তথ্যগুলো সেদিন বেশ এলোমেলো পাচ্ছিলাম। আমার মনে আছে, একটার পরে সেদিন কন্ট্রোল থেকে আর কোন শব্দই পাচ্ছিলাম না।
ট্রাফিকের দায়িত্বে থাকা এক কর্মকর্তা বাংলা আউটলুকের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেন, সূচি অনুযায়ী সকালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর তার কার্যালয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও ৫ তারিখ সকালের দিকে তা পরিবর্তন হয়।
সেদিন গণভবনের পাশেই দায়িত্বরত ছিলেন একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, ভিক্টর টু ( প্রধানমন্ত্রীর কল সাইন) কন্ট্রোল থেকে সকাল ১০ থেকে সোয়া দশটার দিকে জানানো হয়, তিনি বঙ্গভবনে যাবেন। এসময় আমি দেখতে পাই লেক রোড দিয়ে সেনাবাহিনীর অনেক গাড়ি গণভবনে ঢুকছে আবার বের হচ্ছে। কারা গাড়িতে তাও বুঝতে পারছি না।
তিনি বলছিলেন প্রধানমন্ত্রীর জন্য কন্ট্রোলরুমে কথা বলে বঙ্গভবন পর্যন্ত রাস্তা ক্লিয়ার করা হয়।
এ গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, রাস্তায় ক্লিয়ার করার পরেও দেখি উনি বের হচ্ছেন না। সাধারণত ক্লিয়ারেন্স পাওয়ার পরে ১০ থেকে ১৫ মিনিটের মধ্যেই তিনি বের হয়ে যান। কিন্তু সেদিন সময়ের পার হচ্ছে তবুও তিনি বের হচ্ছেন না। কিছু সময় পর জানানো হলো উনার সময়সূচি পরবর্তীতে জানানো হবে। এর মধ্যেই আমি গণভবনের কম্পাউন থেকে ফোন পাই। ভেতরের তথ্য আমার কাছে পরিষ্কার হতে থাকে। বুঝতে পারি সরকার পতন নিশ্চিত হয়েছে।
আরেক কর্মকর্তা অবশ্য বলেন, ৪ আগস্ট রাতে আমরা অফিসে ছিলাম, কারণ ৪ আগস্ট দিবাগত রাতেও একবার বলা হয়েছিল যে বঙ্গভবনে যাবে। পরে যায়নি। আমরা রাত ১১টা থেকে সাড়ে ১১টা পর্যন্ত এভাবে প্রিপেয়ার ছিলাম।
তিনি আরও বলেন, তারপর এভাবে আমরা প্রস্তুত ছিলাম প্রায় ১১.৩০ টা পর্যন্ত। আমাদের কে শেখ কামালের প্রোগ্রাম কাগজে কলমে বলা হলেও, ফোন ও ওয়ারলেস সেটে বঙ্গভবন বলা হচ্ছিল। বেশির ভাগ ফোনে। কারণ ওয়ারলেস সেট অনেকটা প্রকাশিত তাই বেশিরভাগ ফোন। (৫ আগস্ট) আনুমানিক (সকাল) সাড়ে ১১টার দিকে বলা হল আপাতত মুভমেন্ট হচ্ছে না। পরে সময় জানানো হবে। ডিউটিরত ফোর্স ও অফিসারদের সবাইকে একটু রিলাক্স করতে।
সে সময়ে ঢাকা মহানগর পুলিশে কর্মরত একজন কর্মকর্তা জানান, তারা তথ্য পান তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী দশটা থেকে সাড়ে ১১টার মধ্যে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করতে যাবেন। সে হিসেবে সকল প্রস্তুতিও নেওয়া হয়। কি কারণে তিনি দেখা করতে যাবেন সে বিষয়টি আমাদের জানার কথাও না।
সেদিন পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ছিলেন এমন একজন কর্মকর্তা বাংলা আউটলুককে বলেন, "আমরা দেখতে থাকি উত্তরায় ঢাকার প্রবেশ পথ দিয়ে প্রচুর মানুষ ঢুকছে"।
এ বিষয় নিয়ে তৎকালীন ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার হাবিবুর রহমানের সাথে তার কথা হয়। হাবিবুর রহমানের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
দেশের বাইরে থাকা ওই কর্মকর্তা জানান, একপর্যায়ে কাউকে না পেয়ে তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয় উত্তরা থেকে আসা মিছিল প্রতিহত করতে। মিছিল তখনো লামেরিডিয়ানের সামনে। নির্দেশনা মোতাবেক, আমি বনানী পর্যন্ত যাই এরপর আমাকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে ফোন করা হয় । আমাকে এক কর্নেল বলেন, মিছিল তো শহীদ মিনার যাবে, তাকে আটকাবেন কেন? আমি সরে আসি। ততক্ষণে বুঝতে পারি সরকার পতন হয়ে গেছে।
এই কর্মকর্তা সেখান থেকে ফোর্স রেখে চলে যান পুলিশ সদর দপ্তরে।
সেদিন কর্মরত চারজন কর্মকর্তা বলেন, উত্তরা থেকে মিছিলটা ছেড়ে দেওয়া হয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চেয়েছিলেন মিছিলটা যেন জসীমউদ্দীনের আটকে দেওয়া হয়। আমি উত্তরার ডিসি অন্তত ১০ বার ফোন করি। তিনি ফোন ধরেননি। বুঝতে পারি তিনি কম্প্রোমাইজ হয়ে গেছেন। সেনাবাহিনী উত্তরা গেট খুলে দেওয়ার পর দ্বিতীয় চৌকি ছিল মহাখালী ফ্লাইওভারের নিচে। সেদিন সেনা সদস্যরা ১০ মিনিটের বেশি সময় সেই বিশাল মিছিলকে আটকে রাখেন। অন্যদিকে ( তৎকালীন) প্রধানমন্ত্রী তখনও গণভবনে," বলছিলেন ওই চার কর্মকর্তাদের একজন।
তিনি বলেন, তিনি দেখতে পান একপর্যায়ে শেখ হাসিনার গাড়ির বহর লেক রোড বের হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। তবে মিছিল আসছে বুঝতে পেরে নিরাপত্তার কারণে তার বহর গণভবনের সামনে দিয়ে, রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজের বিপরীত দিক দিয়ে যে রাস্তা "বঙ্গবন্ধু ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স সেন্টার" বা চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রের পাশে আগে থেকেই অপেক্ষমাণ বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টারের কাছে নিয়ে যান। সেখান থেকেই তিনি পরবর্তীতে কুর্মিটোলা বিমান ঘাঁটি হয়ে বিমান বাহিনীর বিমান সি ১৩০ করে ভারতে চলে যান।