Logo
Logo
×

অনুসন্ধান

সরকারি বাসভবনে ডিসির ফোয়ারা বিলাস, আছে সুইমিং পুলও

নিজস্ব প্রতিবেদক

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩০ জুলাই ২০২৫, ০৯:২০ পিএম

সরকারি বাসভবনে ডিসির ফোয়ারা বিলাস, আছে সুইমিং পুলও

ডিসির বাসভবনে সীমানা প্রাচীরের ভেতরে সুইমিং পুল (বাঁয়ে) ও নির্মাণাধীন পানির ফোয়ারা। ছবি: বাংলা আউটলুক

প্রতিবছর বন্যা আর নদী ভাঙনে কুড়িগ্রামের মানুষ ঘরবাড়ি আর আবা‌দি জমিসহ শেষ সম্বল হারাচ্ছে। কিন্তু সহায় সম্বল হারানো এই মানুষগুলোর ‍দুঃখগাঁথা কি জেলাটির জেলা প্রশাসককে (ডিসি) ছোঁয়?

ডিসির সরকারি বাসভবনের চিত্র দেখলে মানুষের সেই দুঃখগাঁথা যে ছোঁয় না তা বললে অত্যুক্তি হবে না। বরং বলা যায় ডিসির সরকারি বাসভবন যেন বিলাসিতার প্রতীক। কারণ কোনো নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে সেখা‌নে তৈরি করা হচ্ছে বিশালাকার পানির ফোয়ারা। বাসভবনের সীমানা প্রাচীরের ভেতরে নকশা বহির্ভূতভাবে কয়েক লাখ টাকা ব্যয়ে তৈরি হচ্ছে এই ফোয়ারা। এ যেন ডি‌সির ফোয়ারা বিলাস!

এছাড়াও ডিসির বাসভবন চত্বরে রয়েছে সুইমিং পুল। তবে এসব স্থাপনা নির্মাণে অর্থ বরাদ্দের সুনির্দিষ্ট কোনো খাত জানাতে পারেনি জেলা প্রশাসন। অলংকারিক এই স্থাপনাগু‌লো প্রাচীর বেষ্টিত হওয়ায় স্থানীয় জনগণ এর সৌন্দর্য উপভোগ করার কোনো সুযোগও পায় না। এটি শুধু জেলা প্রশাসকের বিলাসিতার প্রতীক হিসেবে নির্মাণ করা হচ্ছে বলে মত স্থানীয়দের। 

কুড়িগ্রাম ডিসির বাসভবন চত্বরে সুইমিং পুল। ছবি: বাংলা আউটলুক

এছাড়াও উপসচিব পদমর্যাদার একজন জেলা প্রশাসক তার সরকারি বাসভবনে পানির ফোয়ারা কিংবা সুইমিং পুল নির্মাণ করতে পারেন কিনা এবং সরকারিভাবে এসব স্থাপনার সুবিধা পেতে পারেন কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

জেলা প্রশাসন সূত্র বলছে, জেলা প্রশাসকের দ্বিতল বাসভবনের রক্ষণাবেক্ষণ স্থানীয় গণপূর্ত বিভাগ করে থাকে। বাসভবনে কোনকিছু নির্মাণ করার প্রয়োজন হলে তা চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে গণপূর্ত বিভাগ করে থাকে। কিন্তু সম্প্রতি নির্মাণাধীন পানির ফোয়ারাটি গণপূর্ত বিভাগ করছে না। বর্তমান ডিসি নুসরাত সুলতানা নিজস্ব তত্ত্বাবধায়নে ফোয়ারাটি নির্মাণ করছেন। তবে এটি নির্মাণে কোন খাত থেকে অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে তা নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে।

অন্যদিকে, ভবন চত্বরে একটি সুইমিং পুল তৈরি করা হয়েছে। টাইলস ও বিভিন্ন অলংকারিক উপকরণের সমন্বয়ে তৈরি সুইমিং পুলটি উপরে শেড দিয়ে রাখা হয়েছে যাতে এর পানিতে কোনো ময়লা আবর্জনা না পড়ে। ২০২২ সালে তৎকালীন ডিসি রেজাউল করিমের আমলে এটি নির্মাণ করা হয় বলে জেলা প্রশাসন সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

গণপূর্ত বিভাগ বলছে, ডিসি পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বাসভবনে এ ধরনের স্থাপনা নির্মাণের এখতিয়ার তাদের নেই। এসব নির্মাণে তারা সরকারি অর্থ ব্যয় বরাদ্দের অনুমোদন পান না। ফলে গণপূর্তের পক্ষে পানির ফোয়ারা নির্মাণের কোনো সুযোগ নেই। যদিও এ নিয়ে গণপূর্ত বিভাগের কোনো দায়িত্বশীল কর্মকর্তা আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দিতে রাজি হননি।

এদিকে, কুড়িগ্রাম ডিসির বাসভনের রক্ষণাবেক্ষণে গণপূর্ত বিভাগের গত তিন বছরের ব্যয় বরাদ্দের তালিকা যাচাই করে দেখা গেছে, ২০২৩-২০২৪ এবং ২০২৪-২০২৫ অর্থ বছরে ডিসির বাসভবন মেরামত ও রক্ষাণাবেক্ষণে মোট ৬৩ লাখ ৫৬ হাজার টাকা ব্যয় করা হয়েছে। দরপত্রের মাধ্যমে এই অর্থ ব্যয় করা হলেও কাজের তালিকায় ফোয়ারা কিংবা সুইমিং পুল নির্মাণের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। এর আগের দুই অর্থ বছরের কাজের তালিকা যাচাই করেও এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। সরকারি ভবনে এসব স্থাপনা নির্মাণে কোন খাত থেকে অর্থ ব্যয় করা হয়েছে তা নিয়ে স্পষ্ট কোনো তথ্য দিতে পারেনি জেলা প্রশাসন।

রংপুর বিভাগের রংপুরসহ কয়েকটি জেলায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিভাগের অন্যান্য জেলাগুলোর জেলা প্রশাসকের বাসভবনে কোনো সুইমিং পুল কিংবা পানির ফোয়ারা নেই।

স্থানীয় সচেতন নাগরিকরা বলছেন, দারিদ্র পীড়িত কুড়িগ্রামে বন্যা ও নদী ভাঙনে প্রতিবছর হাজারো মানুষ গৃহহীন হচ্ছে। অভাব অনটন এ জেলার বৃহৎ জনগোষ্ঠীর নিত্যসঙ্গী। এখনও অনেক পরিবারের মাথা গোঁজার নিরাপদ কোনো ঠাঁই হয়নি। অথচ একজন ডিসির বাসভবনে অপ্রয়োজনীয় বিলাসিতা বাবদ জনগণের করের লাখ লাখ টাকা ব্যয় করা হচ্ছে। এসব কর্মকান্ড জেলার হতদরিদ্র মানুষের সঙ্গে মশকরার শামিল।

কুড়িগ্রাম ডিসির সরকারি বাসভবন চত্বরে নির্মাণাধীন পানির ফোয়ারা। ছবি: বাংলা আউটলুক

চব্বিশের ছাত্র-জনতার আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়কারী ও জেলা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সংগঠক রাজ্য জ্যোতি বলেন, ‘আমার জেলার মানুষ নদী ভাঙনের শিকার হয়ে প্রতিনিয়ত বাস্তুহারা হচ্ছে। তাদের পুনর্বাসনে সরকার বা প্রশাসনের কোনো উদ্যোগ নেই। নদী তীরবর্তী অঞ্চলে মানুষের কান্না প্রশাসনের কর্তাদের নাড়া দেয় না। অথচ প্রান্তিক মানুষের করের টাকায় তারা আয়েশি জীবন যাপন করেন। সরকারি অট্টালিকা সুবিধা পাওয়ার পরও ডিসির বাসভবনে নিয়ম-বহির্ভূতভাবে পানির ফোয়ারা এবং সুইমিং পুল কীভাবে তৈরি হলো জনগণ তা জানতে চায়। এসবের প্রাপ্যতার বৈধতা নিয়েও জেলাবাসীর প্রশ্ন আছে।’

জানতে চাইলে ডিসি নুসরাত সুলাতানা বলেন, ‘সুইমিং পুলটি আগে তৈরি করা।’ ফোয়ারা তৈরির প্রশ্নে নীরব থাকেন ডিসি। এর অর্থ বরাদ্দের উৎস নিয়ে প্রশ্ন করলেও তিনি কোনো জবাব দেননি। 

এ বিষয়ে জানতে যোগাযোগের চেষ্টা ক‌রেও রংপুর বিভাগীয় কমিশনার শহিদুল ইসলামের সাড়া মে‌লে‌নি। ২৮ জুলাই দুপুরে তাকে ফোন দিয়ে সাংবা‌দিক পরিচয় দেওয়া হলে তিনি পরে ফোন দিতে বলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। এরপর থেকে তাকে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলেও ফোন রিসিভ হচ্ছে না। খুদে বার্তা পাঠিয়েও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এপিডি অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. এরফানুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘এটা বলা মুশকিল। সে (ডিসি) আদৌ এটা করছে কিনা সে ব্যাপারে আমার জানা নেই।’ 

যদিও সরেজ‌মিন কু‌ড়িগ্রাম ডিসির বাসভবনে ফোয়ারা নির্মাণ কাজ চলার প্রমাণ পাওয়া গেছে। 

Logo

ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন