একাত্তরের ইতিহাস পরিবর্তনের উদ্যোগ ইউনূস সরকারের

ছবি: সংগৃহীত
নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পরিবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছে। ইতোমধ্যে পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তন এনেছে। আর জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল সংশোধন অধ্যাদেশ ২০২৫ এর মাধ্যমে ৭১ ইতিহাস থেকে জামায়াতে ইসলামী-মুসলিম লীগ-নেজামে ইসলামের নাম মুছে দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।
ইতোমধ্যে পাঠ্যপুস্তকে মুক্তিযুদ্ধের সংজ্ঞাও সংশোধন করা হয়েছে। অথচ বিষয়টি জানেই না মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন সংজ্ঞা নির্ধারণকারী কর্তৃপক্ষ ‘জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা)’।
জামুকার সর্বশেষ বৈঠকে পাঠ্যপুস্তকের সঙ্গে মিল রেখে সর্বজনীন মুক্তিযুদ্ধ/মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে বিদ্যমান সংজ্ঞা থেকে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলামের নাম মুছে (বাদ) দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।
এমন প্রস্তাবে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ জামুকার সদস্যরা। তারা সাফ জানিয়ে দেন-সবাই জানে কাদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। তৎকালীন মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী নেজামে ইসলাম, আলবদর, আল শামসের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করেছে, এটাই সত্য ইতিহাস এবং সুপ্রতিষ্ঠিত। আমরা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি করতে পারি না।
পরে সিদ্ধান্ত হয়—মুক্তিযুদ্ধের সংজ্ঞায় রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম নামের আগে ‘তৎকালীন’ শব্দ যোগ করে প্রস্তাবিত ‘জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ এর খসড়া চুড়ান্ত করা হবে। খসড়াটি উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে অনুমোদনের জন্য তোলা হতে পারে বলে নিশ্চিত করেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। তবে বিষয়টি নিয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কোনো কর্মকর্তা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ১০ মে জামুকার ৯৬তম সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন জামুকার চেয়ারম্যান ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম বীর প্রতীক। উপস্থিত ছিলেন জামুকার সদস্য মে. জে. (অব.) আজিজুর রহমান, ক্যাপ্টেন (অব.) এম নুরুল হুদা, মেজর (অব.) সৈয়দ মুনিবুর রহমান, মেজর (অব.) কাইয়ুম খান, ইসতিয়াক আজিজ উলফাত, সাদেক আহমেদ খান, হাবিবুল আলম, খ. ম. আমীর আলী, মুক্তিযুদ্ধ সচিব ইসরাত চৌধুরী ও জামুকার মহাপরিচালক শাহিনা খাতুন প্রমুখ।
বৈঠকের সভাপতি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা বলেন, গত ৬ মে উপদেষ্টা পরিষদ সভায় জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইন, ২০২২ সংশোধনকল্পে প্রস্তাবিত অধ্যাদেশ অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হয়। সভায় প্রস্তাবিত অধ্যাদেশ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়।
সভায় জানানো হয়, পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক পাঠ্যপুস্তকে সংশোধনী আনা হয়েছে। উক্ত সংশোধনীগুলোর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের একটি সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। ওই সংজ্ঞার সঙ্গে মিল রেখে সর্বজনীন মুক্তিযুদ্ধ/মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা নির্ধারণ করা প্রয়োজন। সভায় প্রস্তাবিত অধ্যাদেশ এর ২(১১) এবং ২/১৩) উপধারায় ‘মুজাহিদ বাহিনী, মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম’ শব্দগুলি বাদ দিয়ে উপদেষ্টা পরিষদের পরবর্তী সভায় উপস্থাপনের বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া হয়।
সভায় আরও জানানো হয়, যেহেতু জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের ১১, ৯২, ৯৪ ও ৯৫ তম সভায় আলোচনা, সুপারিশ ও সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইন, ২০২২ সংশোধনকল্পে উক্ত অধ্যাদেশ প্রণয়নের প্রস্তাব করা হয়েছে। সেহেতু উপদেষ্টা পরিষদের সভার পরামর্শমতে সংশোধন/পরিমার্জনের জন্য কাউন্সিলের সদস্যদের মতামতের জন্য উপস্থাপন করা হলো।
সভায় উপস্থিত জামুকা সদস্য মেজর জেনারেল (অব.) আজিজুর রহমান বীর উত্তম বলেন, ‘আমরা সবাই জানি কাদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ করেছি। তৎকালীন মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম, আলবদর, আল শামস এদের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করেছে এটি সত্য ইতিহাস।’ তিনি এ শব্দসমূহ বাদ দেওয়ার বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেন।
জামুকাকে না জানিয়ে পাঠপুস্তকে কিভাবে সংজ্ঞা পরিবর্তন করা হলো এই বিষয়ে ক্ষোভ জানিয়ে অপর সদস্য মেজর (অব.) কাইয়ুম খান জানান, পাঠ্যপুস্তকে কি সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে তা জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের জানা নেই। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধার যেকোন সংজ্ঞা একমাত্র জামুকাই দেবে, এ বিষয়ে তাদের জামুকার সঙ্গে আলোচনা করার প্রয়োজন ছিলো। তিনিও প্রস্তাবিত মুক্তিযুদ্ধ ও বীর মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞার প্রস্তাবিত সংশোধনীর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন।
আরেক সদস্য মেজর (অব.) সৈয়দ মুনিবুর রহমান বলেন, ‘আমরা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করতে পারি না। মুক্তিযোদ্ধারা পাক হানাদার ও তাদের এদেশীয় সহযোগী রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস, মুসলিম লীগ, জামায়াত ইসলামী, নেজামে ইসলাম, দালাল শান্তি কমিটির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। এটি সুপ্রতিষ্ঠিত।’
তিনি মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা থেকে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম বাদ দেওয়ার বিরুদ্ধে তার মতামত ব্যক্ত করেন।
অপর সদস্য হাবিবুল আলম বীর প্রতীক জানান, বিদ্যমান জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইন, ২০২২ এ ‘মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম’ শব্দগুলি আছে। উক্ত শব্দগুলি যথার্থভাবেই উক্ত আইন/আদেশ/প্রজ্ঞাপনে সন্নিবেশিত হয়েছে এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাসও তাই। এছাড়াও বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট আইন, ২০১৮ এর ২(১১) ও ২(১৪) নং ধারায় যথাক্রমে—‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ ও ‘মুক্তিযুদ্ধ’-এর সংজ্ঞায় জামায়াতে ইসলামীর কথা বর্ণিত আছে। উক্ত শব্দগুলি প্রস্তাবিত অধ্যাদেশে বাদ দেওয়া সমীচীন হবে না।
এ সময় জামুকার সভাপতি ফারুক-ই আজম মুক্তিযুদ্ধের সংজ্ঞাসহ প্রস্তাবিত অধ্যাদেশের অন্যানা স্থানে মুসলিম লীগ, জামায়াত ইসলামী এবং নেজামে ইসলামের পূর্বে ‘তৎকালীন’ শব্দ যোগ করার প্রস্তাব করা যায় কিনা তা জানতে চাইলে সভায় উপস্থিত সব সদস্য তাতে একমত পোষণ করেন।
তিনি আরও বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় ‘মুজাহিদ বাহিনী’ মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ করেছে।
সেক্ষেত্রে মুজাহিদ বাহিনীর অবস্থান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের পরিবর্তে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বাহিনীগুলোর সঙ্গে থাকা প্রয়োজন। প্রস্তাবিত অধ্যাদেশ ধারা ২ এর উপধারা ১০ এ ‘প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার (মুজিবনগর সরকার)’ এর আলাদা সংজ্ঞায়ন করার প্রয়োজন নেই।
বিদ্যমান আইনে মুক্তিযুদ্ধের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে- ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণায় সাড়া দিয়া দখলদার ও হানাদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম ও মুসলিম লীগ এবং তাহাদের সহযোগী রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস, মুজাহিদ বাহিনী ও পিচ কমিটির বিরুদ্ধে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ মার্চ হইতে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত যুদ্ধ;’
এর পরিবর্তে প্রস্তাবিত অধ্যাদেশে শেখ মুজিবুর রহমানের নাম বাদ দিয়ে প্রস্তাবিত সংজ্ঞায় বলা হয়েছে-‘মুক্তিযুদ্ধ’ অর্থ ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ২৬ মার্চ হইতে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষায় হানাদার ও পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী এবং তাদের সহযোগী মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম ও তদীয় সহযোগী রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস, দালাল ও শান্তি কমিটির বিরুদ্ধে যুদ্ধ;’। এখন এসব রাজনৈতিক দলের নামের আগে ‘তৎকালীন’ শব্দটি যোগ করা হবে।
বিষয়টি নিয়ে জামুকার একাধিক সদস্য কথা বলেছেন এই প্রতিবেদকের সঙ্গে। তারা নাম না প্রকাশ করে বলেন, আমরা এ ধরনের প্রস্তাবে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছি। আমাদের না জানিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ই কী করে পাঠ্যপুস্তকে মুক্তিযুদ্ধের সংজ্ঞা বা ইতিহাস পরিবর্তন করে। এটার বিরুদ্ধে আমরা আমাদের অবস্থান জানিয়েছি। দেখা যাক কী করে সরকার।
এমন এক সময়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এসব কাজ করছে, যখন উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য মাহফুজ আলম চারদিন আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নিজের আইডিতে লিখেছেন,
‘দুটি কথা ১. ’৭১ এর প্রশ্ন মীমাংসা করতেই হবে। যুদ্ধাপরাধের সহযোগীদের ক্ষমা চাইতে হবে। বাংলাদেশে রাজনীতি করতে হলে পাকিস্তানপন্থা বাদ দিতে হবে। পাকিস্তান এদেশে গণহত্যা চলিয়েছে। (পাকিস্তান অফিসিয়ালি ক্ষমা চাইলেও, তদুপরি আবারো ক্ষমা চাইতে রাজি হলেও, যুদ্ধাপরাধের সহযোগীরা এখনো ক্ষমা চায়নি)। ইনিয়ে বিনিয়ে গণহত্যার পক্ষে বয়ান উৎপাদন বন্ধ করতে হবে। জুলাইয়ের শক্তির মধ্যে ঢুকে স্যাবোট্যাজ করা বন্ধ করতে হবে। সাফ দিলে আসতে হবে।
২. মুজিববাদী বামদের ক্ষমা নাই। লীগের গুম-খুন আর শাপলায়, মোদীবিরোধী আন্দোলনে হত্যাযজ্ঞের মস্তিস্ক এরা। এরা থার্টি সিক্সথ ডিভিশন। জুলাইয়ের সময়ে এরা নিকৃষ্ট দালালি করেও এখন বহাল তবিয়তে আছে। আজ পর্যন্ত মুজিববাদী বামেরা কালচারালি ও ইন্টেলেকচুয়ালি জুলাইয়ের সাথে গাদ্দারি করে যাচ্ছে। দেশে বসে জুলাইয়ের পক্ষের শক্তির বিরুদ্ধে এরা চক্রান্ত করেই যাচ্ছে। লীগের এসকল বিটিম ও শীঘ্রই পরাজিত হবে। অন্য কারো কাঁধে ভর করে লাভ নেই।’