তালেবানের হয়ে পাকিস্তান সীমান্তে যুদ্ধ করছেন বাংলাদেশি তরুণেরা

হাসান আল মাহমুদ
প্রকাশ: ১৫ মে ২০২৫, ০৬:৪৯ পিএম
গত ২৭ এপ্রিল পাকিস্তানের উত্তর ওয়াজিরিস্তানে পাকিস্তান-আফগান সীমান্তে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অভিযানে 'তেহরিকে তালিবান পাকিস্তানের (টিটিপি) ৫৪ সদস্য নিহত হন। ওই দিনই পাক সেনাবাহিনীর বিবৃতিতে জানানো হয়, আফগানিস্তান থেকে পাকিস্তানে অনুপ্রবেশ চেষ্টার সময় তাদের হত্যা করা হয়।
টিটিপির পক্ষ থেকে নিহতদের কোনো তালিকা প্রকাশ করা হয়নি। তবে নিহতদের মধ্যে অন্তত একজন বাংলাদেশি তরুণ ছিলেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
নিহত বাংলাদেশির নাম আহমেদ জোবায়ের। তার বাড়ি ঢাকার সাভারের আড়াপাড়ায়। এলাকার লোকজন ও বন্ধুবান্ধবের কাছে তিনি 'যুবরাজ' নামে পরিচিত ছিলেন।
জোবায়েরের মা আলেয়া আক্তার দ্য ডিসেন্টকে (The Dissent) জানিয়েছেন, এপ্রিল মাসের শেষ দিকে কেউ একজন ফোন করে তার একমাত্র ছেলে আহমেদ জোবায়েরের মৃত্যুর খবর জানান।
কে ফোন করেছে বা ফোনকারীর নম্বরটি শেয়ার করা যায় কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ''আমি বাটন ফোন ব্যবহার করি। কেউ একজন ফোন দিয়ে বললো, আপনার ছেলে আমাদের সাথে জিহাদে ছিল। শত্রুদের হাতে শহীদ হয়েছে। জান্নাতের পাখি হয়ে গেছে। আরো কী কী বলেছে মনে নাই। ওই নম্বর আমি চিনি না।''
এদিকে বাংলাদেশ থেকে 'হিজরত করে' পাকিস্তান-আফগান সীমান্তে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধরত আছেন বলে দাবি করা অন্তত দুজন ব্যক্তির ফেসবুক প্রোফাইল থেকে পোস্ট করে জানানো হয় যে, আহমেদ জোবায়ের নামে তাদের একজন বাংলাদেশি সহযোদ্ধা ২৭ এপ্রিল পাক সেনাবাহিনীর হামলায় 'শহীদ' হয়েছেন।
দ্য ডিসেন্ট দুটি প্রোফাইলের একজনের পরিচয় যাচাই করতে সক্ষম হয়েছে এবং তার অবস্থান যে বর্তমানে আফগানিস্তানে সে বিষয়ে ওই ব্যক্তির একাধিক বন্ধু এবং বাংলাদেশে তার সাবেক সহকর্মীদের সাথে কথা বলে নিশ্চিত হয়েছে।
সাভার থেকে আফগানিস্তান:
আহমেদ জোবায়ের ওরফে যুবরাজের জন্ম ২০০৩ সালের ৮ এপ্রিল। তিনি গত বছর সাভার কলেজে ইসলামিক স্টাডিজের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। এর আগে সাভারের অধর চন্দ্র হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং আশুলিয়ায় অবস্থিত মির্জা গোলাম হাফিজ কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন।
২০২৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত সাভারে বাস করা জোবায়ের একই বছরের নভেম্বরে উমরাহর উদ্দেশ্যে সৌদি আরব যান বলে জানিয়েছে তার পরিবার।
মা আলেয়া আক্তার জানান, ওমরায় গিয়ে তাওয়াফ করার সময় ভিডিও কলে তার সাথে কথা বলছিলেন জোবায়ের।
২৭ এপ্রিলের পর টিটিপির সাথে সংশ্লিষ্ট বাংলাদেশি কয়েকটি ফেসবুক প্রোফাইল (যেগুলোর বেশিরভাগই ছদ্মনাম) ও পেইজ থেকে পোস্ট করা হয় যে, আহমেদ জোবায়ের নামে এক বাংলাদেশি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অভিযানে মারা গেছেন। এরপর The Dissent এই ঘটনার সত্যতা ও নিহতের পরিচয় খুঁজতে অনুসন্ধান শুরু করে।
এসব ফেসবুক প্রোফাইল থেকে নিয়মিত টিটিপির বিভিন্ন খবর, ছবি ও ভিডিও পোস্ট করা হয় এবং উগ্রপন্থীদের সাথে যুক্ত হতে তরুণদেরকে উৎসাহিত করা হয়। অনেক বাংলাদেশি ফেসবুক ব্যবহারকারীদেরকে এসব পোস্টে 'কীভাবে আমি আফগানিস্তান যেতে পারি?' 'কীভাবে আপনাদের সাথে জিহাদে যোগ দিতে পারি?' এসব মন্তব্য করতে দেখা যায়।
জোবায়েরের মৃত্যু সংক্রান্ত ফেসবুক পোস্টগুলোতে সাভার এলাকার কয়েকজন তরুণের মন্তব্য পাওয়া যায়, যার সূত্র ধরে জোবায়েরের পরিবারকে চিহ্নিত করে তার বাবা আনোয়ার হোসেন, মা আলেয়া আক্তার, দুইজন সহপাঠী বন্ধু এবং পাঁচজন প্রতিবেশীর সাথে কথা বলেছে দ্য ডিসেন্ট। যদিও বিষয়টির স্পর্শকাতরতার কারণে বাবা-মা সংবাদমাধ্যমের সাথে খোলাখুলি সব প্রশ্নের উত্তর দিতে রাজি হননি। এবং নিরাপত্তার কারণে বন্ধু ও প্রতিবেশীরা তাদের পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে কথা বলেছেন।
বাবা আনোয়ার হোসেন জানান, গত নভেম্বরে ওমরাহর উদ্দেশ্যে সৌদি আরব যান জোবায়ের। ওমরাহ শেষ হলে বাড়ি না ফেরার কারণ হিসেবে "আল্লাহর দ্বীন প্রচারের কাজে ব্যস্ত আছেন" বলে মা-বাবাকে জানান ছেলে।
এর আগে দেশে থাকতে জোবায়ের তাবলীগের চিল্লায় যেতেন বলে জানিয়েছেন আনোয়ার হোসেন ও এবং জোবায়েরের দুই বন্ধু। ওমরাহতে যাওয়ার আগে আগেই তাবলীগের এক চিল্লা (৪০ দিন) দিয়ে আসেন তিনি। এর আগে আরও দুই চিল্লা করেছেন বলে পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়।
জুবায়েরর মা আলেয়া আক্তার বলেন, "ওমরাহ করতে গেছে। এরপর আমাদের কিছু বলেনি... কোন দেশ থেকে কোন দেশে গেছে। আল্লাহ বলতে পারবে আর অয় বলতে পারবে। কী ভূত চাপলো, কাগো লগে গেলো, কোন পাল্লায় পড়লো আমরা বাবায়.." বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
নিহত হওয়ার খবর ফোনকলে পাওয়ার সপ্তাহ খানেক আগে মায়ের সাথে ফোনে কথা হয় জোবায়েরের। এর আগে নিয়মিত যোগাযোগ রাখলেও তিনি কোথায় আছেন সে ব্যাপারে নির্দিষ্ট করে পরিবারকে জানাননি বলে দাবি করেছেন তার বাবা-মা।
"জিজ্ঞেস করলে বলতো 'আল্লাহর পথে কাম করি।' চিন্তা করুম, কান্দুম এর লাইগা হয়তো কয় নাই কিছু। একবার ওমরায় তাওয়াফ করার সময় আমার সাথে ভিডিও কলে কথা বলছিল", বলেন আলেয়া আক্তার।
কান্নাভেজা কণ্ঠে ছেলেকে নিয়ে আফসোস তাঁর, "আল্লাহর কাছে কত কইলাম আল্লাহ তুমি আমার হায়াত দিয়া সন্তানকে বাঁচায়া রাইখো। আমরা বাঁইচা রইলাম, আমার সন্তান গেলোগা।"
জোবায়েরের এক সাবেক সহপাঠী বন্ধু, যিনি বর্তমানে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত, নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি জানান, বিদেশে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তারা একসাথে এলাকায় চলাফেরা করতেন।
উমরাহ পালনে সৌদিতে যাওয়ার পরও জোবায়ের নিয়মিত হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ রাখতেন বন্ধুদের সাথে। এর মধ্যে বিশ্বস্ত কয়েকজনকে তার আফগানিস্তানে যাওয়ার কথা বলেছিলেন।
সর্বশেষ গত ঈদুল ফিতরের পরপর (এপ্রিল মাসের শুরুতে) ওই বন্ধুর সাথে কথা হলে তখনও জোবায়ের জানিয়েছেন আফগানিস্তানে অবস্থান করে 'জিহাদ' করছেন।
জোবায়েরের বন্ধু বলেন, আফগানিস্তানের একটি এলাকার নাম বলেছিল একবার যেখানে সে থাকে। কিন্তু আমি অতোটা গুরুত্ব দিয়ে শুনিনি তাই নামটি এখন আর মনে নাই। তালেবানের মারকাজে (ঘাঁটি) থাকার কথাও বলেছিল আরেকবার। জোবায়েরের এই বন্ধুও একজন তাবলীগী যুবক। তিনি জানান তাকেও 'হিজরত করে আল্লাহর পথে জিহাদের জন্য' উদ্বুদ্ধ করতেন জোবায়ের।
জোবায়েরের এই বন্ধু বলেন, ও বলছিল তাবলীগের ইন্টারন্যাশনাল জামায়াতে গেলে হিজরত করাটা সহজ হয়। আর ইন্টারন্যাশনাল জামায়াতে যাওয়ার সুযোগ পাওয়ার জন্য ৩ চিল্লা (এক চিল্লা ৪০ দিন) তাবলীগে সময় কাটাতে হয়। হিজরত করতে সুবিধা হয় ইন্টারন্যাশনাল জামায়াতের সাথে এমন কোন দেশে পাড়ি জমাতে হয়। পরে সেখান থেকে পাড়ি দিতে হয় আসল গন্তব্যে।
জোবায়ের ইন্টারন্যাশনাল জামায়াতে যাওয়ার জন্য বেছে নেন সৌদি আরবকে। তাবলীগের একটি জামায়াতের সাথেই ওমরাহ করতে সৌদি পাড়ি জমান তিনি।
জুবায়েরের অন্য আরেকজন বন্ধু ফেসবুকে মন্তব্য করেছেন, "খুব কাছের বন্ধু ছিল ও আমার। দেখলেই বলতো কী ভাই জিহাদ করবা না? শরীর ঠিক করতে হবে তো।"
জোবায়েরের কয়েকটি গ্রুপ ছবি পাওয়া গেছে যেখানে এ বন্ধুটিকেও দেখা যাচ্ছে কয়েকজন মিলে একসাথে কোথাও (বেড়াতে গিয়ে) গোসল করছেন।
কথা হয় জুবায়েরের প্রতিবেশী মধ্যবয়সী একজন নারীর সাথে। তিনি বলেন, "জোবায়ের ভালো ছেলে ছিল। নামাজ পড়তো, ভদ্রভাবে চলতো। আমরা জানতে পেরেছি সে ফিলিস্তিনে গিয়ে শহীদ হয়েছে। ওর মায়ের কান্নাকাটি দেখে জিজ্ঞাসা করে জোবায়েরের মৃত্যুর খবর জানতে পেরেছি।"
জোবায়েরের বাসার নিকটস্থ কসাইপাড়া জামে মসজিদে কথা হয় ষাটোর্ধ্ব একজন মুসল্লির সাথে যিনি জোবায়েরের প্রতিবেশীও। তিনি বলেন, "ওর পরিবার মারফতে আমরা জেনেছি জোবায়ের ফিলিস্তিনে গিয়ে শহীদ হয়েছে। এর চেয়ে বেশি কিছু আমরা জানি না।"
প্রথমে জোবায়েরের পরিবারের পক্ষ থেকে প্রতিবেশীদেরকে 'ফিলিস্তিনে গিয়ে যুদ্ধ করে শহীদ হওয়ার' কথা বলা হয়। অবশ্য The Dissent এর পক্ষ থেকে আফগানিস্তানে নিহত হওয়ার বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তার বাবা বলেন, 'আমরা নিশ্চিত ছিলাম না কোথায় শহীদ হয়েছে।'
বাংলাদেশি একটি পরিবার:
পাক-আফগান সীমান্তে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে আহত হয়েছেন এবং বর্তমানে যুদ্ধক্ষেত্রে অবস্থান করছেন এমন একজন বাংলাদেশি হলেন সাইফুল্লাহ। তিনি গত ১৩ মে ২০২৫ তারিখে দ্য ডিসেন্টকে অনলাইনে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন।
সাইফুল্লাহ জানিয়েছেন এটি তার সত্যিকারের নাম। যদিও তার ফেসবুক প্রোফাইলটি এই নামের সাথে অন্য আরেকটি শব্দ যুক্ত করে খোলা। নিজের ব্যাপারে শুধু নামের বাইরে কোন পরিচয়যোগ্য তথ্য দিতে রাজি হননি সাইফুল্লাহ।
"আমরা যারা অন্য দেশ থেকে জিহাদের জন্য হিজরত করি তারা নিজেদের প্রকৃত নাম-পরিচয় সাধারণত ব্যবহার করি না। তবে আমার এই নামটিই আসল নাম", বলেন তিনি।
সাইফুল্লাহর ফেসবুক প্রোফাইলের গত ২ বছরের পোস্ট, ছবি, ভিডিও এবং আফগানিস্তানে থাকা অন্য আরও কয়েকজন বাংলাদেশির বিভিন্ন ফেসবুক পোস্ট বিশ্লেষণ করে দ্য ডিসেন্ট এটা নিশ্চিত হয়েছে যে, তিনি আফগানিস্তানে টিটিপির হয়ে যুদ্ধ করেছেন।
তবে নীতিগত কারণে সাইফুল্লাহ বা অন্যদের ফেসবুক আইডির পুরো নাম, কোন পোস্টের স্ক্রিনশট ইত্যাদি প্রকাশ করা থেকে The Dissent বিরত থাকছে।
সাইফুল্লাহ জানান, তিনি তার পরিবারসহ আফগানিস্তানে 'হিজরত' করেন ২০২২ সালের শেষের দিকে। এমবিএ পাশ করে ঢাকার একটি কলেজ থেকে ডিগ্রি পাশ করা স্ত্রীকে তিনি তালেবানশাসিত আফগানে পাড়ি জমান। সাভারের আহমেদ জোবায়ের তার সাথেই একসময় থাকতেন। পরে তাদের অবস্থান ভিন্ন জায়গায় হলেও পরস্পরের বিষয়ে খোঁজখবর ছিল।
জোবায়েরের বিষয়ে তিনি বলেন, ও আর আমি পাকতিকায় (আফগানিস্তানের প্রদেশ) একসাথে ছিলাম। ২৪ সালের অক্টোবর বা নভেম্বরে সে ওখানে আসে। বর্তমানে ওখানে (পাকতিকায়) সব কার্যক্রম বন্ধ আছে।
সাইফুল্লাহ বর্তমানে কাবুলে আছেন।
তিনি বলেন, অনেকের (মৃত্যুর) ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত না। তবে জোবায়েরের ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত যে, সে শহীদ হয়েছে। আমাদের আলাদা আলাদা জেলা ভিত্তিক দল থাকে। আমাদের দলের ১৫ জন ওই অপারেশনে ছিল, সবাই শহীদ হইছে।
সাইফুল্লাহ বর্তমানে পঙ্গু অবস্থায় থাকায় যুদ্ধে অংশগ্রহণের সুযোগ নেই। তিনি দাবি করেন, ২০২৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর পাকতিকায় প্রদেশে পাকিস্তান বাহিনীর ড্রোন হামলায় অন্য অনেকের সাথে তার পুরো পরিবার আক্রান্ত হয়। বড় মেয়ে মার্জিয়া ইলমা-- যার বয়স তখন ২ বছর ৭ মাস-- ঘটনাস্থলেই মারা যায়। ৯ মাসের ছোট মেয়ে, গর্ভবতী স্ত্রী গুরুতর আহত হন। স্ত্রীর গর্ভপাত হয় এবং সাইফুল্লাহ এক পা হারিয়ে পঙ্গু হয়ে যান। এছাড়া তার মেরুদণ্ডও ভেঙে যায় বোমার আঘাতে।
বার্তা সংস্থা এএফপির ২০২৪ সালের ২৫ ডিসেম্বরের এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, আগের দিন আফগানিস্তানের পাকতিকায় পাক বাহিনীর ড্রোন ও বিমান হামলায় অন্তত ৪৬ জন ব্যক্তি মারা গেছেন, যাদের মধ্যে অনেকেই নারী ও শিশু ছিলেন বলে দাবি করেছিলেন তালেবানের মুখপাত্র। এএফপি স্থানীয় বাসিন্দাদের বরাতে জানিয়েছে, একটি পরিবারের ১৮ সদস্য ওই হামলায় নিহত হন।
এ ঘটনার পর সাইফুল্লাহ তার ফেসবুক প্রোফাইলে নানান সময়ে তার ও পরিবারের সদস্যদের দুরাবস্থার বিষয়ে পোস্ট ফলোয়ারদের জানিয়েছেন এবং তার আহত শরীরের ছবি ও চিকিৎসা সংক্রান্ত কিছু ডকুমেন্ট শেয়ার করেছেন।
১৩ মে ছিল সাইফুল্লাহ দম্পতির বড় মেয়ে মার্জিয়া ইলমার জন্মদিন। এই দিনে স্বামী-স্ত্রী তাদের কন্যার জন্ম ও মৃত্যুর স্মৃতিচারণ করে নিজেদের ফেসবুক প্রোফাইলে দুটি ভিন্ন পোস্ট করেছেন। দুজনই ইলমার দুটি আলাদা ছবি যুক্ত করেছেন তাদের পোস্টে। উভয় ছবিতেই ইমোজি দিয়ে মুখঢাকা একটি শিশু কন্যাকে দেখা যাচ্ছে; যে দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়ি উপত্যকা-সদৃশ ঘাসহীন পাথুরে ভূমির উপর।
সাইফুল্লাহ সাইফুল্লাহকে বলেছেন, তিনি সোশাল মিডিয়ায় টিটিপির বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের দেখভালের দায়িত্বপ্রাপ্ত। সংগঠনটির কেন্দ্রীয় মুখপাত্র মোহাম্মদ খোরাসানী তাকে নিয়োগ করেন।
তবে তার এই দাবির সত্যতা কোনো ডকুমেন্টের ভিত্তিতে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হয়নি। তিনি বলেছেন, তার জানা মতে বর্তমানে আফগানিস্তানে অন্তত ৮ জন বাংলাদেশি রয়েছেন যারা টিটিপির পক্ষে যুদ্ধ করছেন। এছাড়া জোবায়ের ও মার্জিয়া ইলমার মৃত্যুর আগে অন্তত আরো দুই বাংলাদেশি সেখানে নিহত হয়েছেন বলে দাবি তার।
এদের মধ্যে একজনের নাম 'আবরার', যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফার্মাসি থেকে পড়াশোনা করেন বলে জানান সাইফুল্লাহ। তিনি বলেন, আবরারের নিজস্ব ব্যবসা ছিল। হ্যান্ডসাম ছেলে ছিল। সবার পরে এসে সবার আগে (যুদ্ধ করতে গিয়ে) শহীদ হন। পাঞ্জাব মীওয়ালিতে শহীদ হন। গত এপ্রিলে যান ওখানে। মীওয়ালিতে অভিযানে গিয়ে শহীদ হন।
আরেকজনের নাম 'ইবনে তাইমিয়াহ' যিনি সাইফুল্লাহ তথ্য মতে, ২ বছর আগে 'হিজরত' করেন।
সাইফুল্লাহ বলেন, আমি আর তাইমিয়া এক সময় একসাথে ছিলাম। মাস দেড়েক আগে পাহাররত অবস্থায় অ্যাম্বুশে শহীদ হন। ডেরা গাজি খানের দিকে কোন এক জায়গায় শহীদ হন তিনি। পটিয়া বা হাটহাজারি মাদ্রাসা থেকে পড়াশোনা করেছেন।
নিহত আবরার ও ইবনে তাইমিয়া এবং জীবিত বাংলাদেশিদের বিষয়ে এর চেয়ে বেশি তথ্য দিতে রাজি হননি তিনি। এদের পরিচয় এবং অন্যান্য তথ্য আলাদাভাবে দ্য ডিসেন্ট যাচাই করতে পারেনি।
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কেন লড়াই করছেন-- এমন প্রশ্নের জবাবে সাইফুল্লাহ জানান, পাকিস্তান ইসলামিক ইমারত প্রতিষ্ঠার জন্য তারা চেষ্টা করছেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে 'তাগুত' হিসেবে অভিহিত করে তিনি বলেন, ''তাগুত কুফফার ভাই ভাই''।
পাকিস্তানি একজন সাংবাদিক যা বলছেন:
টিটিপির বর্তমান কার্যক্রম এবং এর সাথে বাংলাদেশিদের সংশ্লিষ্টতা বিষয়ে জানতে খাইবার পাখতুনখোয়া থেকে পাকিস্তানি এবং বিদেশি সংবাদমাধ্যমে কাজ করা সাংবাদিক আদনান বাচার সাথে কথা বলেছে দ্য ডিসেন্ট। তিনি জানান, বাংলাদেশিদের টিটিপি সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে তেমন কোনো তথ্য পাকিস্তানের মূলধারার সাংবাদিকদের জানা নেই।
আদনান বলেন, প্রাথমিকভাবে আমরা যা জানি সেটা হলো পাকিস্তানি, পশতু, উজবেক, কাজাক নাগরিকরা টিটিপিতে কাজ করে। বাংলাদেশিরা কতটুকু জড়িত সেটা সম্পর্কে আমাদের তেমন ধারণা নাই।
তিনি আরও বলেন, আফগানিস্তানে পাড়ি জমানোর সবচেয়ে সহজ পথ হচ্ছে সমুদ্রপথ। করাচি বন্দর কিংবা বেলুচিস্তান হয়ে সৌদি কিংবা আরব আমিরাত থেকে আফগানিস্তানে পাড়ি জমানো তুলনামূলক সহজ। বেলুচিস্তানে টিটিপির একটা শক্ত অবস্থান আছে। আরেকটা পথ হচ্ছে কাশ্মীর হয়ে পাড়ি জমানো। প্রথমে ভারতীয় কাশ্মীর, পরে সেখান থেকে পাকিস্তান কাশ্মীর হয়ে আফগানিস্তান।
তিনি বলেন, "আমরা মনে করি ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে টিটিপিকে সমর্থন যোগাচ্ছে। তালেবানের সাথে ভারতের সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে কারণ ভারত আফগানিস্তানে বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে।"
কী বলছে বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষ?
বাংলাদেশ পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম এন্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) বিভাগের প্রধান মো. মাসুদ করিমকে আহমেদ জোবায়েরের মৃত্যুর বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, "তার বিষয়ে আপডেটেড তথ্য আমাদের কাছে নেই।"
বাংলাদেশ সেন্টার ফর টেরোরিজম রিসার্চ এর প্রধান এবং বাংলাদেশ পিস এন্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের সিনিয়র ফেলো শাফকাত মুনীরও জানিয়েছেন আফগানিস্তানে বাংলাদেশিদের যাওয়ার বিষয়ে অতি সাম্প্রতিক তথ্য তার কাছে নেই।
তিনি বলেন, "আমরা বাংলাদেশে সন্ত্রাসী হামলার সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করতে সফল হয়েছি। প্রকৃতপক্ষে আমরা পরিস্থিতি এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছি যে, সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো তাদের কার্যকরী সক্ষমতা অনেকটাই হারিয়েছে। কিন্তু আমাদের সব সময় তরুণদের উগ্রপন্থার দিকে ঝুঁকে যাওয়ার ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে। তাছাড়া এই উগ্রপন্থী কার্যকলাপের একটা বড় অংশ এখন হয়ে থাকে সাইবার স্পেসে। তাই সাইবার স্পেসে আমাদের নজরদারি এবং সচেতনতা বাড়াতে হবে।"
টিটিপি কারা?
২০০৭ সালে পাকিস্তানে শরিয়া শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বায়তু্ল্লাহ মেহসুদ এর নেতৃত্বে গঠিত হয় তেহরিক ই তালিবান পাকিস্তান। মূলত পাকিস্তান সরকারের মদদে যেসব যোদ্ধা আফগানিস্তানে সোভিয়েতের বিরুদ্ধে ও ভারতের কাশ্মিরে লড়াই করেছিল তারাই যখন পাকিস্তান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ'কে সমর্থন জানায় তখন পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে চলে যায়।
আফগানিস্তানে মার্কিন হামলা শুরু হওয়ার পর এসব যোদ্ধারা আফগান তালেবান, আল-কায়দা ও অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্যদের পাকিস্তানে আশ্রয় দেয়া শুরু করে।
পাকিস্তান সরকার যখন এক পর্যায়ে তাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা শুরু করে তখন কয়েকটি সশস্ত্র গোষ্ঠী একত্রিত হয়ে ২০০৭ গঠন করে টিটিপি।
বর্তমানে আন্তর্জাতিকভাবে সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হিসেবে স্বীকৃত টিটিপি তৎকালীন তালেবান প্রধান মোল্লা ওমরকে তাদের আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে ঘোষণা করে এবং সংগঠনটিকে তালেবানের একটি শাখা হিসেবে দেখা হয়। পাক-আফগান সীমান্তের দুই পাশে রয়েছে এই সন্ত্রাসী সংগঠনটির শক্তিশালী অবস্থান।
https://www.facebook.com/share/1HRmCJh5yg/
পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্রোকে হত্যা করার দায় স্বীকার করেছে টিটিপি। সংগঠনটির বেশ কয়েকটি আত্মঘাতী হামলায় পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের পাশাপাশি বিপুল পরিমাণে সাধারণ মানুষেরও প্রাণহানি ঘটে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হামলা, যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন হামলা ও অন্তর্কোন্দলে ২০১৪ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত টিটিপির শক্তিমত্তা অনেকটা স্তিমিত হয়ে আসে। তবে ২০২১ সালে তালেবান কাবুলের মসনদ দখল করার পর থেকে তালেবানের সমর্থন ও মার্কিন বাহিনীর ফেলে যাওয়া অত্যাধুনিক সব অস্ত্র হস্তগত হওয়ার বদৌলতে শক্তিমত্তা বাড়তে থাকে সংগঠনটির।
জাতিসংঘের এক রিপোর্ট অনুসারে, বর্তমানে আফগানিস্তানে টিটিপির ৬ হাজার থেকে সাড়ে ৬ হাজার যোদ্ধা সক্রিয় রয়েছে।
সূত্র: দ্য ডিসেন্ট