Logo
Logo
×

অনুসন্ধান

রেলে লুটপাটের প্রধান সেনাপতি আলমগীর

জুলকারনাইন সায়ের

জুলকারনাইন সায়ের

প্রকাশ: ১৩ মার্চ ২০২৫, ০৮:৩০ পিএম

রেলে লুটপাটের প্রধান সেনাপতি আলমগীর

ছবি: বাংলা আউটলুক

শেখ হাসিনা সরকারের আমলে স্থানীয় ঠিকাদারদের মধ্যে রেলপথ মন্ত্রণালয়ে টাকার অংকে সবচেয়ে বেশি কাজ করেছে ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড। মূলত আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী দুই নেতার হস্তক্ষেপে রেলে একের পর এক প্রকল্প বাগিয়ে নিয়েছে ম্যাক্স। টেন্ডার প্রক্রিয়ার কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে একচেটিয়া দরপত্র পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। 

সময়টা ২০১১ সাল। তখন খুঁড়িয়ে চলছে ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার। ওই সময়ে মাত্র ৫ থেকে ১০ কোটি টাকার ছোট ছোট নির্মাণ কাজ করতো প্রতিষ্ঠানটি। তাও টেনেটুনে শেষ করতে হতো। ব্যাংক লোন নিয়ে চলতো প্রকল্পের কাজ। তখন এককভাবে মাত্র ১৬.৭০ কোটি টাকার রেললাইন প্রকল্প নির্মাণের অভিজ্ঞতা ছিলো ম্যাক্সের। তাও কাজের মান ছিল নিম্ন। কিন্তু আওয়াম লীগের মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ও মির্জা আজমের সহায়তায় রাতারাতি বদলে যায় ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার। মন্ত্রীর সহায়তায় দরপত্রে ১৫ নম্বরে থেকেও ২০৯ কোটি টাকার চিনকি আস্তানা হতে আশুগঞ্জ রিনিউয়াল রেল প্রকল্পের কাজ পেয়ে যায় ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার। 

ওই প্রকল্প পেতেও জালিয়াতি করে ম্যাক্স। মাত্র ১৬ কোটি টাকার একটি কাজের সঙ্গে আরও দুটি চলমান প্রকল্প ৫০ ও ৯৬ কোটি টাকার যোগ্যতা একসঙ্গে দেখিয়ে চিকনি প্রকল্পের দরপত্রে অংশগ্রহণ করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি। পরে মন্ত্রীর লিখিত সুপারিশে কাজও পেয়ে যান। 

মূলত সেখান থেকেই ম্যাক্সের উথান শুরু। তারপরে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। পরে শেখ হাসিনা সরকারের নির্মাণ খাতের মাফিয়া খ্যাত দুই প্রভাবশালী নেতার সরাসরি হস্তক্ষেপে রেলে একের পর এক বড় বড় প্রকল্পের কাজ পেতে থাকে ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার। এই দুই নেতার প্রভাব খাঁটিয়ে রেলের সব প্রকল্প একাই গিলে খেয়েছে গ্রুপটি। গত ১৫ বছরে উন্নয়ন খাতের অন্তত ৬০ হাজার কোটি টাকার কাজ করেছে ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার, যা দেশের উন্নয়ন খাতে নজিরবিহীন ঘটনা। 

শেখ হাসিনা সরকার পতনের পরে এখনো রেল সিন্ডিকেট ধরে রেখেছে ম্যাক্স গ্রুপ। চিকনি আস্তানার পরে কাশিয়ানি-গোপালগঞ্জ রেল প্রকল্পের একাধিক অবকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়নের কাজ পায় ম্যাক্স। এখনও রেলের বড় দুটি প্রকল্পেও কাজ করছে গ্রুপটি। 

কিভাবে পূর্ব অভিজ্ঞাতা ছাড়াই ২০৯ কোটি কাটার চিকনি আস্তানা ক্ষয়প্রাপ্ত রেল প্রকল্প, ২০১১ সালে ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকার লাকসাম-চিনকি আস্তানা রেল প্রকল্প, ২০১৫ সালে ৬ হাজার কোটি টাকার আখাউড়া লাকসাম রেলপথ প্রকল্প, ২০১৬ সালে ১৮ হাজার কোটি টাকার দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের কাজ পেলো ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার। ৪ নম্বর গ্রেডের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হয়েও তারা কিভাবে রেলের এতোবড় প্রকল্প বাগিয়ে নিলো? 

এতো অল্প সময়ে কোন শক্তির জোরে যোগাযোগ খাতে মাফিয়া হলে উঠলো প্রতিষ্ঠানটি? কোন ক্ষমতার বলে এমন একচেটিয়া আধিপত্য করতে পারলো ম্যাক্স। ১৬ কোটি টাকার কাজ পাওয়ার যোগ্য প্রতিষ্ঠান কিভাবে ১৮ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প পেলো তা নিয়ে রেল খাতে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। তবে দরপত্রে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী দুই নেতা জড়িত থাকায় ম্যাক্সের তেলেসমাতি কাণ্ড নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলার সাহস পাননি। অনুসন্ধানের ম্যাক্স গ্রুপের জাল জালিয়াতি ও ক্ষমতার পেছনে কারা তা বেরিয়ে এসেছে। 

ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচারের চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার গোলাম মোহাম্মদ আলমগীর। নিজেকে আওয়ামী লীগ সরকারের অন্যতম দাতা হিসেবে পরিচয় দিতেন। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরে দুর্নীতির দায়ে জেলও খেটেছেন। এখনও দুর্নীতির মামলা চলমান আছে। বিগত সরকারের আমলে সবচেয়ে বেশি সুবিধা পাওয়া ঠিকাদারদের মধ্যে অন্যতম এই আলমগীর। 

রেলওয়ে ছাড়াও সম্প্রতি ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক উন্নয়ন প্রকল্পে ২ হাজার ৩২০ কোটি টাকার উন্নয়নকাজ পেয়েছে ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার। চীনের দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে সড়কটির একাংশের নির্মাণকাজ পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। রেলের আরেক শীর্ষ ঠিকাদার তমা কনস্ট্রাকশন। দোহাজারী-কক্সবাজার ও আখাউড়া-লাকসাম রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পে একাধিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে ৬ হাজার ১৬১ কোটি টাকার কাজ করছে তমা। প্রতিষ্ঠানটির মালিক আতাউর রহমান ভূঁইয়া। একসময় নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশ নিয়ে পরাজিত হন তিনি। তমা কনস্ট্রাকশনের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজমের সম্পৃক্ততা রয়েছে। তবে তিনি সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ঘনিষ্ঠজন বলেই যে প্রকল্পের কাজ চেয়েছে তাই-ই পেয়েছেন ম্যাক্স লিমিটেড। 

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচারের মালিক গোলাম মোহাম্মদ আলমগীর আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা মির্জা আজমের বন্ধু। আওয়ামী লীগের একটি উপকমিটিতেও নাম রয়েছে এই আলমগীরের। সেই সুবাদে মির্জা আজমের সহায়তায় রেলের সব প্রকল্পে একচ্ছত্র আধিপত্য দেখাতেন ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার। দরপত্রে যোগ্যতার মাপকঠিতে ১০ নম্বরে থেকেও রেলের একের পর এক প্রকল্পের কাজ পেয়েছেন ম্যাক্স লিমিটেড। একপ্রকার প্রতিযোগিতাহীনভাবে রেলের ৯০ শতাংশ প্রকল্পের কাজ পেয়েছে ম্যাক্স গ্রুপ। ৩০ শতাংশ কমিশনের বিনিময়ে তিনি কাজ পেতেন বলে রেল সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র নিশ্চিত করেছেন। 

মির্জা আজমের একটি ঘনিষ্ট সূত্র বলছে, গত ১৫ বছরে রেলের ৭০ হাজার কোটি টাকার কাজ একাই নিয়ন্ত্রণ করেছেন মির্জা আজম। শেখ রেহানা সিন্ডিকেটের প্রধান হয়ে কাজ করেছেন মির্জা আজম। এসব প্রকল্প দুটি তৃতীয় সারির ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পেয়েছে। তাদের কাছ থেকে বড় অঙ্কের কমিশন নিয়েই এসব কাজ তাদের দেওয়া হয়েছে। মির্জা আজম শুধুমাত্র মিডিয়া, পুরো টাকা চলে গেছে শেখ রেহানার কাছে। ম্যাক্সের মালিক আলমগীরের সঙ্গেও শেখ রেহানার ব্যক্তিগত যোগাযোগ ছিল। 

যেভাবে প্রতারণা করেছে ম্যাক্স

ঠিকাদারি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আন্তর্জাতিক দরপত্রে জয়েন্ট ভেঞ্চারের শর্ত মোতাবেক, শুধু পার্টনার হিসেবে টেন্ডারে অংশগ্রহণ করতে হলে ওই প্রকল্পের মোট মূল্যের অন্তত ২৬ শতাংশ মূল্যমানের কাজ করার অতীত অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। কিন্তু ম্যাক্সের ২ শতাংশ কাজ করার অভিজ্ঞতাও ছিল না। 

অনুসন্ধানে জানা গেছে, কক্সবাজার রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পের দরপত্র বিজ্ঞপ্তির শর্তানুযায়ী দরপত্র দলিল দাখিলের সময় ম্যাক্স তাদের দেওয়া অতীত অভিজ্ঞতার সপক্ষে যে আইনগত পরিচয় ও কাজের কথা (লাকসাম-চিনকি আস্তানা দ্বৈত রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প) উল্লেখ করেছে, তা ছিলো অস্পষ্ট ও জালিয়াতিতে পরিপূর্ণ। এজন্য তারা যে পদ্ধতি অবলম্বন করেছে তাতে তারা বিদেশি লিড পার্টনার চায়না রেলওয়ে মেটারিয়াল ইম্পটেন্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট কোম্পানি লিমিটেডের অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে প্রথমত ওই কাজে তাদের অংশ নেওয়ার সুযোগ করে নিয়েছে। পরে ওই কাজের পুরো অভিজ্ঞতাকেই নিজের বলে দাবি করে চালিয়ে দিয়েছেন, যা রেল খাতের একটি ভয়ঙ্কর জালিয়াতি ছিলো।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলের এক কর্মকর্তা বলেন, দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন নির্মাণের কাজটি মূল প্রকল্প দলিল ডিপিপি ও সংশোধিত প্রকল্প দলিল আরডিপিপি মোতাবেক একক কাজ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত ছিল। যোগ্যতার মানদন্ডে অতীত অভিজ্ঞতায় আর্থিক মূল্যমানের সীমারেখা বিবেচনায় ম্যাক্সকে ওই প্রকল্পের কাজ পাইয়ে দেওয়ার জন্য এই একক কাজকে তৎকালীন প্রকল্প পরিচালক মফিজুর রহমান ও মহাপরিচালক আমজাদ হোসেন দুই ভাগে ভাগ করেছিলেন; যেটি লট-১ ও লট-২ প্যাকেজ নামে পরিচিত। লট-২ প্যাকেজের কাজ ম্যাক্স লিমিটেড নিয়েছিলো একটি চাইনিজ ঠিকাদারে সাথে জয়েন্ট ভেঞ্চার করে। 

সংরক্ষিত বনাঞ্চল, পরিবেশ,পাহাড় ও জীববৈচিত্রের ধংস করে শেখ হাসিনার রেল সিন্ডিকেট তমা কনস্ট্রাকশন ও ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচারের মাধ্যমে রেললাইন নির্মাণের কাজ দেখিয়ে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ও পৃষ্ঠপোষকতায় রেল সেক্টরে সর্ববৃহৎ দুর্নীতির মহোৎসবের আয়োজন হয়। ভয়াবহ অনিয়ম বুঝতে পেরে এই প্রকল্পের মূল্যায়ন প্রতিবেদনে স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে নিজেকে সরিয়ে নেন মূল্যায়ন কাজের অন্যতম সদস্য বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হাসিব মোহাম্মদ আহসান।  এডিবির সরাসরি ইন্ধন ও অন্তর্ভুক্তিতে তমা ও ম্যাক্স গ্রুপের মাধ্যমে বাংলাদেশ রেলওয়ের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তার সরাসরি সহযোগিতায় এই সেক্টরে ঋণ গ্রহণের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাটের এক মহোৎসব সম্পন্ন করা হয়েছে। ২০১১ থেকে ২০১৬ সালে সম্পাদিত ওইসব ক্রয় চুক্তির মহোৎসবে যে সব দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তা জড়িত ছিলেন তাতে তৎকালীন মহাপরিচালক আমজাদ হোসেন, সাগর কৃষ্ণ চক্রবর্তী, নাজনীনা আরা কেয়া, লিয়াকত আলী খান, মফিজুর রহমান ও আবুল কালাম চৌধুরী।

এছাড়া ৭২ কিলোমিটার লম্বা আখাউড়া-লাকসাম ডাবল লাইন রেল নির্মাণ কাজের চুক্তি সম্পাদিত হয় ১৫ জুন ২০১৫ সালে ৬৫০৪ কোটি টাকায়। বাস্তবায়নকারী সিটিএম চায়না রেলওয়ে গ্রুপ, তমা কনস্ট্রাকশন কোম্পানি, ম্যাক্স লিমিটেড। যৌথভাবে ওই প্রকল্পের কাজ সম্পাদন করেছে। এই চায়না রেলওয়ে গ্রুপ কক্সবাজার প্রকল্পে তমা কনস্ট্রাকশন কোম্পানির সঙ্গে যৌথভাবে যুক্ত। আর প্রকল্প পরিচালক সাগর কৃষ্ণ চক্রবর্তী ছিলেন এই সিন্ডিকেটের আলোচিত অন্যতম সদস্য। কক্সবাজার প্রকল্পের পরিচালক মফিজ যাচাই ছাড়া এবং টিবিইআর সদস্যদের মতামত ব্যতিরেখে এডিবিতে পাঠিয়ে অনুমোদন করান। আর এর মাধ্যমেই এক বিশাল দুর্নীতির প্রয়াসের সফল সমাপ্তি হয়। এভাবেই রেলওয়ের কতিপয় কর্মকর্তা, অযোগ্য দুই ঠিকাদার এবং এডিবি'র সরাসরি ইন্ধন ও অন্তর্ভুক্তিতে রেলওয়ে খাতে দুর্নীতির টাকা লুটপাটের মহোৎসব চালু হয়।

রিকোয়ারমেন্টে যা বলা হয়েছে

এই প্রকল্পের দরপত্রে অংশগ্রহণের জন্য ঠিকাদারদের অতীত অভিজ্ঞতার সপক্ষে বিগত ১০ বছরের মধ্যে কমপক্ষে ১টি কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে যার মূল্যমান ২৭০ মিলিয়ন ডলার; যা ২২৬৮ কোটি টাকা এবং ট্র্যাক, ব্রিজ, ইমব্যাংকমেন্ট, স্টেশন বিল্ডিং, সিগন্যালিং ও টেলিকমিউনিকেশন কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। যদি প্রতিষ্ঠানটি জয়েন্ট ভ্যাঞ্চার করে তাহলে লিড পার্টনারের জন্য কাজের বৈশিষ্ট এবং মূল্যমানের ক্ষেত্রে পুরো অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। পার্টনারদের ক্ষেত্রেও ঐরূপ অভিজ্ঞতা ও বৈশিষ্ট থাকতে হবে তবে সেটা মূল্যমানের ক্ষেত্রে ২৫ শতাংশ থাকলেই চলবে। অর্থাৎ ২২০৮ কোটি টাকার ২৫ শতাংশ যা ৫৬৭ কোটি টাকা। ম্যাক্স যে কাজের অভিজ্ঞতার সনদ দিয়েছে সে কাজে ম্যাক্সের আইনগত অন্তর্ভুক্তির বিষয়টা কেমন ছিলো? টিএসসির মতামতগুলো প্রকল্প পরিচালক মফিজুর রহমান মাধ্যমে টেকনিক্যাল বিড ইভালুয়েশন রিপোর্ট এড়িয়ে গিয়ে কিভাবে প্রভিয়াসলি কমপ্লাইড স্টাটাসকে কমপ্লাইড করে দিয়েছিল। পরবর্তীতে সেই রিপোর্ট এডিবিতে গেলে পরবর্তীতে সেই জবাব হুবহু উল্লেখ করে প্রকল্পের পরিচালক মফিজুর রহমান ম্যাক্সের জবাবকে বৈধতা দিয়ে সুপারিশসহ এডিবির কাছে পাঠিয়ে দুর্নীতির ষোল কলাপূর্ণ করে। লাকসাম চিনকি আস্তানা দ্বৈত রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প বাংলাদেশ রেলওয়ের সঙ্গে ক্রয়চুক্তি সম্পাদিত হয় সিআরএম জয়েন্ট ভ্যাঞ্চার অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে। ম্যাক্স এখানে শুধু পার্টনার। কাজের সফল সমাপ্তিতে লিড পার্টনার চায়না রেলওয়ে মেটারিয়াল ইম্পটেন্ট অ্যান্ড এক্সপোর্টকে বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রকল্প পরিচালক কর্তৃক অভিজ্ঞতার যে সনদ দেওয়া হবে তাতে পার্টনার হিসেবে ম্যাক্স এর নামও উল্লেখ থাকবে। ম্যাক্স এই অভিজ্ঞতার ক্রেডিনশিয়ালিটি পাবে জয়েন্ট ভেঞ্চার এসোশিয়েশন  করার সময় ওই এসোসিয়েশনে তার অন্তর্ভুক্তির পার্সেন্ট হিসেবে।

পদে পদে জালিয়াতি করে ম্যাক্স

২০১১ সালের ১৭ অক্টোবর বাংলাদেশ রেলওয়ের সঙ্গে সিআরএম জয়েন্ট ভেঞ্চার অ্যাসোসিয়েশনের চুক্তি হয়। চুক্তির দেড় মাস পর, ওই অ্যাসোসিয়েশনের তিনটি প্রতিষ্ঠানের যৌথ স্বাক্ষরে প্রকল্পের প্রধান প্রকৌশলীকে একটি চিঠি দেওয়া হয়।

চিঠিতে জানানো হয়, জয়েন্ট ভেঞ্চারে থাকা দুটি চীনা কোম্পানি—চায়না রেলওয়ে ম্যাটেরিয়াল ইম্পোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট ও চেঙ্গু রেলওয়ে কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড—অনিবার্য কারণে প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম, জনশক্তি, যন্ত্রপাতি ও অর্থ দ্রুত আনতে পারবে না। ফলে তাদের লোকাল পার্টনার ম্যাক্সই প্রকল্পের ১০০% কাজ সম্পন্ন করবে এবং যোগ্যতার সনদও এককভাবে পাবে।

পরে জয়েন্ট ভেঞ্চারের অভ্যন্তরীণ বোঝাপড়ার ভিত্তিতে ম্যাক্স স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ডিসেম্বরে প্রকল্পের প্রধান প্রকৌশলীর কাছে আরেকটি চিঠি পাঠায়। এতে তারা উল্লেখ করে, ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত পাঁচ মাসের সময় কাজে লাগানোর জন্য দ্রুত কাজ শুরু করতে হবে। তবে লিড পার্টনার দুটি বিদেশি প্রতিষ্ঠান সময়মতো প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম আনতে পারবে না।

চুক্তি অনুসারে, প্রকল্প বাস্তবায়নে অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো যৌথ ও পৃথকভাবে দায়বদ্ধ। যদি কোনো অংশীদার তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়, তাহলে অন্য অংশীদারকে বাকি কাজ শেষ করতে হবে। সে অনুযায়ী, জয়েন্ট ভেঞ্চারের পক্ষে এককভাবে প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করার দায়িত্ব পড়ে ম্যাক্সের ওপর।

সিআরএম জয়েন্ট ভেঞ্চারের পক্ষ থেকে ম্যাক্স ইতোমধ্যেই ১০% পারফরম্যান্স গ্যারান্টি জমা দিয়েছে। জয়েন্ট ভেঞ্চারের লিড পার্টনার চায়না রেলওয়ে ম্যাটেরিয়াল ইম্পোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট এবং পার্টনার চেঙ্গু রেলওয়ে কনস্ট্রাকশন সম্মতি দিয়েছে যে, ম্যাক্স নিজস্ব যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম ব্যবহার করে পুরো প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করবে। এ বিষয়ে তাদের মধ্যে একটি চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়েছে।

তবে, এই সিদ্ধান্ত নৈতিক ও যৌক্তিকতার বাইরে, ক্রয় চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করে এবং ক্রয় আইন পরিপন্থী। এমন একতরফা চুক্তির মাধ্যমে একটি অস্বচ্ছ পরিস্থিতি তৈরি করা হয়। এরপর, ম্যাক্স জানায়, প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য তাদের একটি বড় অঙ্কের ব্যাংক ঋণ প্রয়োজন। কিন্তু ব্যাংক জানায়, তারা শুধুমাত্র তখনই ঋণ দেবে যদি বাংলাদেশ রেলওয়ে ম্যাক্সকে ১০০% কাজের অনুমতি দেয়।

পরবর্তীতে, ম্যাক্স প্রকল্পের পুরো কাজ এককভাবে সম্পন্ন করার অনুমতি চায় এবং দাবি করে, কাজ শেষ হলে বাংলাদেশ রেলওয়ের পক্ষ থেকে তাদের নামে ১০০% প্রতিযোগিতা সনদ ইস্যু করতে হবে।

এই কৌশলের মাধ্যমে মাত্র ১৬.৭ কোটি টাকার কাজের অভিজ্ঞতা থাকা ম্যাক্স লিমিটেড ১৮০০ কোটি টাকার প্রকল্পের যোগ্যতা অর্জন করে। পরবর্তীতে, এই অভিজ্ঞতাকে ভিত্তি করে তারা ১৮,০০০ কোটি টাকার কক্সবাজার প্রকল্পের কাজ পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে।

জয়েন্ট ভেঞ্চারে চীনা দুটি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে মেটারিয়াল ইম্পোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট ও চেঙ্গু রেলওয়ে কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড থাকার পরও কেন ম্যাক্স লিমিটেড তাদের বাদ দিয়ে এককভাবে প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করল? চুক্তি সম্পাদনের পরই কেন এমন প্রস্তাব দেওয়া হলো, যেখানে মূলত লিড পার্টনার হিসেবে চায়না রেলওয়ের অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতা যাচাই করেই এই জয়েন্ট ভেঞ্চার অনুমোদন পেয়েছিল? এটি কি পূর্বপরিকল্পিত কৌশল ছিল? কাজ পাওয়ার পরই কেন এমন অবান্তর ও চুক্তিবহির্ভূত প্রস্তাব উপস্থাপন করা হলো? প্রকল্প পাওয়ার আগে কারিগরি মূল্যায়ন কমিটির যাচাইয়ের পরও কেন পরবর্তীতে লিড পার্টনারকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হলো? ক্রয় আইন, বিধি ও চুক্তির শর্ত অনুযায়ী এটি কতটা বৈধ? ক্রয় আইন অনুসারে, জয়েন্ট ভেঞ্চারে অংশগ্রহণ করা প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্মিলিত অভিজ্ঞতা যাচাই করেই কাজ বরাদ্দ দেওয়া হয়। তাহলে চীনা প্রতিষ্ঠানগুলোর অভিজ্ঞতা যাচাইয়ের পর তাদের অন্তর্ভুক্ত করা হলেও কেন পরবর্তীতে তাদের বাদ দিয়ে ম্যাক্সকে এককভাবে কাজ সম্পন্ন করার সুযোগ দেওয়া হলো? ম্যাক্স লিমিটেড এককভাবে অভিজ্ঞতার সনদ পাওয়ার যোগ্য কি না? কোনো প্রতিষ্ঠান যদি জয়েন্ট ভেঞ্চারের মাধ্যমে কাজ পায়, তাহলে চুক্তি অনুযায়ী তারা এককভাবে অভিজ্ঞতার সনদ পেতে পারে কি না? ১৬ কোটি টাকার কাজের অভিজ্ঞতা থাকা ম্যাক্স কীভাবে ১৮০০ কোটি টাকার প্রকল্পের জন্য যোগ্য বিবেচিত হলো? এই পরিকল্পনার চূড়ান্ত উদ্দেশ্য কি ছিল? যদি জয়েন্ট ভেঞ্চারের নিয়ম মেনে কাজ করা হতো, তাহলে ম্যাক্স এককভাবে অভিজ্ঞতা দাবি করতে পারত না। তাহলে এই জালিয়াতির উদ্দেশ্য কি কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পের ১৮,০০০ কোটি টাকার কাজ পাওয়ার জন্য যোগ্যতা তৈরি করা?

যেভাবে অভিজ্ঞতা সনদ নেয় ম্যাক্স

ম্যাক্স দাবি করেছিল যে চায়না রেলওয়ে মেটারিয়াল ইম্পোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট ও চেঙ্গু রেলওয়ে কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড তাদের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম এদেশে আনতে পারবে না। কিন্তু বাস্তবে নির্মাণ কাজের মূল উপাদানগুলো সরবরাহ করেছে লিড পার্টনার চায়না রেলওয়ে মেটারিয়াল ইম্পোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট। প্রকল্পের প্রধান প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালক বাংলাদেশ রেলওয়ের প্যাডে এই সার্টিফিকেট ইস্যু করেন, যেখানে বলা হয় যে লিড পার্টনার কারিগরি নির্দেশনা অনুসারে সময়মতো প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সরবরাহ সম্পন্ন করেছে।

এতে স্পষ্ট হয় যে ম্যাক্সের দেওয়া তথ্য অসত্য ছিল। চীনা কোম্পানি দুটি নিজেদেরকে সরিয়ে নিয়ে শুধু ম্যাক্সের অনুকূলে অভিজ্ঞতার সনদ দেওয়ার জন্য যে দাবি করেছিল, সেটি মিথ্যা। কারণ, প্রকল্পের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান রেলপথের ৭ হাজার টন রেললাইন সরবরাহ করেছিল তারাই। প্রশ্ন ওঠে, কীভাবে লিড পার্টনার চায়না রেলওয়ে মেটারিয়াল ইম্পোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট ও পার্টনার চেঙ্গু রেলওয়ে কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড প্রকল্পের কাজের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত থেকেও নিজেদের সম্পৃক্তহীন ঘোষণা করে ম্যাক্সকে ১০০ শতাংশ অভিজ্ঞতার সনদ দেওয়ার শর্তকে সমর্থন করল।

আরও অবাক করার বিষয় হলো, প্রকল্পের প্রধান প্রকৌশলী (পিডি) ও রেলওয়ের মহাপরিচালক (ডিজি) এই শর্তকে অনুমোদনও দিলেন। এতে স্পষ্ট হয়, মূল পরিকল্পনাই ছিল কক্সবাজার রেল প্রকল্পের জন্য ম্যাক্সকে যোগ্যতা অর্জনের সুযোগ করে দেওয়া। লাকসাম-চিনকি আস্তানা দ্বৈত রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের কাজ মূলত পেয়েছিল চীনা কোম্পানি দুটি। তারা চুক্তি অনুযায়ী যৌথভাবে কাজও শেষ করেছিল। ফলে, প্রকল্পের অভিজ্ঞতার সনদ জারি হওয়ার কথা ছিল তিনটি কোম্পানির নামে, শুধুমাত্র ম্যাক্সের নামে নয়।

কিন্তু সার্টিফিকেট জারির সময় প্রকল্পের প্রধান প্রকৌশলী ও পরিচালক চাতুর্যের আশ্রয় নেন, যার যথাযথ প্রমাণ প্রতিবেদকের কাছে সংরক্ষিত আছে। ২০১১ থেকে ২০১৬ সালে হওয়া এই ক্রয় চুক্তিতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মধ্যে ছিলেন তৎকালীন মহাপরিচালক আমজাদ হোসেন, সাগর কৃষ্ণ চক্রবর্তী, নাজনীনা আরা কেয়া, লিয়াকত আলী খান, মফিজুর রহমান ও আবুল কালাম চৌধুরী।

এই বিষয়ে জানতে ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে, তাদের মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশন ম্যানেজার ইব্রাহিম খালিদ পলাশ জানান, তারা বিস্তারিত ব্যাখ্যা পরে লিখিত আকারে দেবেন। কিন্তু একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও পরে আর ম্যাক্সের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া মেলেনি।


Logo

প্রধান কার্যালয়: ৬০৯০ ডাউসন বুলেভার্ড, নরক্রস, জর্জিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।

ই-মেইল: banglaoutlook@gmail.com

অনুসরণ করুন