চীনের প্রভাব বাড়ার সাথে সাথে ভারত বাংলাদেশ সীমান্তে হত্যা বাড়িয়ে দিয়েছে : মেজর জেনারেল (অব.) ফজলুর রহমান

প্রকাশ: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০১:৪৬ এএম

১৮ এপ্রিল, ২০০১ সালে স্বাধীনতার ৩০ বছর পর বাংলাদেশ প্রথম বহির্শত্রু দ্বারা প্রত্যক্ষ আক্রমণের শিকার হয়। সৈন্য সংখ্যা এবং অস্ত্র অনেক কম থাকার পরও পরিপূর্ণ বিজয় অর্জন করে বাংলাদেশ। ২০০১ সালের এপ্রিল মাসে যখন তৎকালীন বিডিআর প্রধান মেজর জেনারেল (অব.) আ.ল.ম ফজলুর রহমান জানতে পারেন, ভারতীয় বিএসএফ নোম্যান্স ল্যান্ডের ওপর দিয়ে রাস্তা নির্মাণ করে বাংলাদেশের এলাকা ‘পদুয়া’কে যুক্ত করছে। পদুয়ায় অস্থায়ী বিএসএফ ক্যাম্প করেছে। বিডিআরের পক্ষ থেকে বারবার প্রতিবাদ করার পরও ভারতীয় পক্ষ থেকে কোনো সহযোগিতা করা হলো না। এমনকি ফ্ল্যাগ মিটিংয়েও রাজি হলো না তারা। বাংলাদেশের সার্বভৌম এলাকার ওপর এ রকম আচরণে এপ্রিলের ১৫-১৬ তারিখ রাতে মেজর জেনারেল ফজলুর রহমানের নির্দেশে চার শ’র মতো ফোর্স পদুয়ায় ভারতীয় বিএসএফ ক্যাম্প ঘেরাও করে ফেলে। বিএসএফের প্রায় ৭০ জনের মতো সৈনিক ছিল সেদিন। মাত্র ছয়টা ফায়ার করার পরই বিএসএফ সৈন্যরা সেখানে আত্মসমর্পণ করে। বিডিআর পদুয়ার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেয়। ১৬ তারিখ সমঝোতা শুরু হয় ভারতের সঙ্গে। কথা ছিল সমঝোতা চলাকালীন কোনো পক্ষ সামরিক পদক্ষেপ থেকে বিরত থাকবে। এ সমঝোতা যখন ডাহুকীতে চলছিল, তখন ভারত বিশ্বাসঘাতকতা করে। বাংলাদেশের অজান্তে ১৮ এপ্রিল ভোরের আলো ফোটার আগেই কুড়িগ্রাম জেলার রৌমারী উপজেলার বরাইবাড়ী এলাকার অংশ এবং বিডিআর ক্যাম্প দখলে নিতে ভারতীয় সেনাবাহিনী ও বিএসএফের সমন্বয়য়ে গঠিত প্রায় ৫০০ ফোর্স বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢুকে আগ্রাসন চালায়। সেখানে তখন বিডিআরের মাত্র ১১ জন সদস্য ছিল। ভারতীয় সৈন্যদের আকস্মিক গুলিতে শহীদ হন বিডআরের ল্যান্স নায়েক মো. ওহিদুজ্জামান। আগুনের মতো জ্বলে ওঠেন বিডিআরের বাকি ১০ জওয়ান। মাত্র দুটো সাব মেশিনগান এবং সাধারণ অস্ত্র নিয়ে দুই দিক থেকে ভারতের বিশাল বাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন তারা। প্রথম পাল্টা আক্রমণেই ভারতীয় বাহিনীর ১৭/১৮ সেনা নিহত হন।
ভারতীয় হানাদার বাহিনীকে ওখানেই আটকে রাখা হয়। এরই মধ্যে মেজর জেনারেল ফজলুর রহমানের নির্দেশে ময়মনসিংহ এবং নেত্রকোনা থেকে প্রায় চার শ ফোর্স সেখানে চলে যায়। খোলা জায়গায় ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে প্রচণ্ড যুদ্ধ শুরু হয়। ভারতীয় বাহিনী আগেই থমকে গিয়েছিল, বিডিআরের পাল্টা আক্রমণে দিশাহারা হয়ে তারা পালাতে থাকে তারা। বাংলাদেশের সীমানায় ফেলে যায় ১৮টি মৃতদেহ। আর সাথে নিয়ে যায় আরো প্রায় ১৭৪টি মৃতদেহ। অবশ্য বিডিআর’র তিনজন শহীদ হন। ভারতীয় বাহিনী পূর্ণ পরাজয় মেনে নিয়ে পালিয়ে যায়।
সম্প্রতি বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে বিজিবি সদস্য ও সাধারণ মানুষ হত্যার প্রেক্ষিতে বাংলা আউটলুকের সঙ্গে কথা হয় ওই ঘটনার নায়ক মেজর জেনারেল (অব.) আ ল ম ফজলুর রহমানের সঙ্গে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন বাংলা আউটলুকের ঢাকা প্রতিনিধি।
বাংলা আউটলুক: সাম্প্রতিক সময়ে বিশেষ করে গত ১৫ বছরে ভারতের বিএসএফ’র গুলিতে সীমান্ত হত্যা বেড়ে গেছে, এর কারণ কি?
ফজলুর রহমান: বিষয়টি আমরা খুব নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছি। বাংলাদেশে চীনের প্রভাব বাড়ার সাথে সাথেই ভারত বর্ডার কিলিং বাড়িয়ে দিয়েছে। চীনের কোনো উচ্চপদস্থ কেউ বাংলাদেশ সফরে আসার আগে-পরে এ ঘটনা খুব কৌশলে ঘটায় ভারত। গত সপ্তাহে চীন সরকারের একজন ডেলিগেট সফর করে গেল। এর পরপরই ভারত বাংলাদেশকে চাপে রাখার জন্যই এই হত্যা করেছে। বিজিবি সদস্য হত্যার পরদিনই একজন সাধারণ নাগরীককে গুলি হত্যা করল।
বাংলা আউটলুক: ভারতের সাথে অন্য দেশেরও তো সীমান্ত রয়েছে, সেখানে এমন কিলিংয়ের খবর পাওয়া যায় না। যদিও ভারত বাংলাদেশের পরীক্ষিত বন্ধু বলে উচ্চস্বরেই দাবি করে।
ফজলুর রহমান: সীমান্তের নিরাপত্তায় নিয়োজিত সব দেশের বাহিনী গুলি করতে পারে। ১৯৭৫ সালে ভারতের সাথে বাংলাদেশের সীমান্ত চুক্তি অনুযায়ী, দুই দেশের বর্ডারে কোনো ব্যাক্তি লিথাল উইপন অবৈধভাবে (আগ্নেয়াস্ত্র) বহন করলে, তাকে গুলি করার অনুমতি আছে। কিন্তু তাও কোমরের নিচে গুলি করতে পারবে। সন্দেহভাজন ওই ব্যাক্তিকে বিএসএফ বা বিজিবি আটক করে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করতে বাধ্য ওই চুক্তি অনুযায়ী। কিন্তু ভারত এই চুক্তি ভঙ্গ করছে। সাম্প্রতিক সময়ে এই প্রবণতা বেড়েছে। এটি বাংলাদেশ সরকারের দুর্বলতা। অপর দিকে নেপাল সীমান্তে ভারতের বিএসএফ কিছুদিন আগে গুলি করে এক নেপালী নাগরীককে হত্যা করেছিল। নেপালের মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। পরবর্তীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এ হত্যার দায় স্বীকার করে প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়েছে। কিন্তু আমাদের সরকারের নতজানু নীতির কারণে আমরা সেটা পারছি না। আমাদের ফেলানি, রইস উদ্দিনরা খুন হয়; আমরা নীরবে মেনে নিচ্ছি।
বাংলা আউটলুক: বাংলাদেশের করণীয় কি?
ফজলুর রহমান: অবশ্যই করণীয় আছে। অনেক কিছু করা যায়। সীমান্ত চুক্তি ভঙ্গের অপরাধে সাধারণ মানুষও মামলা করতে পারে। নাগরিক সমাজ ঢাকার আদালতেও মামলা করতে পারে।
বাংলা আউটলুক: ভারতের বিএসএফ’র বিরুদ্ধে বাংলাদেশের আদালতে মামলা করার পরিস্থিতি দেশে আছে?
ফজলুর রহমান: কেন নেই? নাগরীকের পক্ষে যে কেউ করতে পারে। দেশের আদালত মামলা না নিলে, বিদেশের আদালতে, আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করা যায়। ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলের অবৈধ হামলা ও গণহত্যার দায়ে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা হয়েছিল। বিচারও হয়েছে। ইসরায়েল বিচার মানতে বাধ্যও হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষেরও উচিত এখন ভারতের বিরুদ্ধে সীমান্ত হত্যার দায়ে মামলা করা।
বাংলা আউটলুক: ভারতের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে বর্ডার হাট, মৌত্রী ট্রেন, ছিটমহল চুক্তিসহ বহু উদ্যোগ নিয়েছে, এরপরেও এমন হত্যাকাণ্ড কী বার্তা দেয়?
ফজলুর রহমান: পরিষ্কার বার্তা, ভারত আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র, কিন্তু বন্ধু রাষ্ট্র নয়। বন্ধুর বুকে গুলি চালালে বন্ধত্ব টেকে না। যদি এরপরও টিকে থাকে, তাহলে বুঝতে হবে, আমরা দুর্বল বা তাদের কাছে আমরা জিম্মি। সুতরাং ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্ব হবে, তবে সেটা সীমান্ত চুক্তি এবং স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব টিকিয়ে রেখে।
বাংলা আউটলুক: সরকারের কোনো কুটনৈতিক দুর্বলতা আছে বলে মনে করছেন?
ফজলুর রহমান: সরকারের দুর্বলতা আছে কী না, সে বিষয়ে মন্তব্য করতে চাই না। তবে, সদিচ্ছার ঘাটতি তো দৃশ্যমান। প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের ভারত সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, বিচ্ছিন্ন ঘটনা। আমাদের সরকারও সেটা মেনে নিয়ে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে চালিয়ে দেয়। এগুলোর একটিও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, পরিকল্পিত। কারণ, কিছুদিন আগে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ প্রকাশ্যে বলেছেন, বাংলাদেশের মানুষ ‘উইপোকা’। আর আসামের মুখ্যমন্ত্রী তো বাংলাদেশকে দখলেরই কথা বলেছেন। ভারতের মানচিত্রে বাংলাদেশের বেশ কিছু এলাকা একীভুত করে কিছুদিন আগে সেটি প্রকাশও করেছে। সুতরাং এ থেকে পরিষ্কার, এগুলোর একটিও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। পরিকল্পিত। এবং সবগুলোই ভারত সরকারের সিদ্ধান্ত।
বাংলা আউটলুক: সমাপ্তির পথ কি?
ফজলুর রহমান: বাংলাদেশ সরকারকে প্রতিটি ঘটনার পর তীব্র প্রতিবাদ করতে হবে। বিচারের জন্য চাপ দিতে হবে। বিএসএফকে আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের মুখোমুখী করতে হবে। এখানে সৌজন্যতা বা দুর্বলতা প্রকাশ করা যাবে না। কঠোর হতে হবে।
বাংলা আউটলুক: আপনাকে ধন্যবাদ।
ফজলুর রহমান: বর্ডার কিলিং বন্ধের জন্য সাধারণ মানুষ যাতে কথা বলে, সে জন্য গণমাধ্যমের অনেক ভূমিকা রয়েছে। আশা করছি, বাংলা আউটলুক লেখার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মহলে ভারতের বিজিবির এসব হত্যাকাণ্ড তুলে ধরবে। বাংলা আউটলুককেও ধন্যবাদ।