ওয়েবিনারে বক্তারা
জনগণকে বিভ্রান্ত করার বাজেট দিয়েছে সরকার
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৬ জুলাই ২০২৪, ০৭:০৭ পিএম
দেশে জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল সরকার না থাকায় জাতীয় বাজেট থেকে বরাবরই সাধারণ জনগণ উপেক্ষিত হচ্ছে। আজকে যখন দেশে ব্যাপকভাবে কর্মসংস্থান প্রয়োজন তা নিয়ে বাজেটে কোনো দিকনির্দেশনা নাই। শিক্ষাখাতে বাজেট কমছে। অথচ বাজেটে কালো টাকা সাদার সুযোগ দিয়ে দুর্নীতিকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। অথচ আমাদের বাজেটে বৈষম্য নিরসন, দুর্নীতি দমন ও জনগণের কর্মসংস্থানের বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকার প্রয়োজন ছিল।
আজ শনিবার (৬ জুলাই) ফোরম ফর বাংলাদেশ স্ট্যাডিজের বাজেট ২০২৪-২৫: কেমন হবে অর্থনীতির আগামী দিন শীর্ষক বিশেষ ওয়েবিনারে অংশ নিয়ে বক্তারা এসব কথা বলেন।
সাংবাদিক মনির হায়দারের উপস্থাপনায় ওয়েবিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিডনি পলিসি অ্যানালিসিস সেন্টারের আন্তর্জাতিক বিষয়ক পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ জ্যোতি রহমান। এতে সমাপনী বক্তব্য দেন সুশানের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদা। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর, কলামিস্ট ও রাজনীতি বিশ্লেষক জাহেদ উর রহমান ও উন্নয়ন ও অর্থনীতি গবেষক জিয়া হাসান ওয়েবিনারে আলোচক হিসেবে অংশ নেন।
জ্যোতি রহমান তার মূল প্রবন্ধে উল্লেখ করেন, মাইক্রো ইকোনমিক এনালেসিস আগে প্রচুর হতো। এখন সেভাবে হয় না। কেননা আগে জিনিসপত্রের দাম কমতো এখন সেভাবে কমে না। তবে বাজেট এখনো প্রাসঙ্গিক মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদের জন্য। হাসিনা সরকারের এ বাজেটের পাঁচটি প্রধান দিক উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখনকার সময়ে বাজেট ঘাটতি বাড়ছে এরা কারণ অর্থ আহরণ নয় ব্যয়। এছাড়া উন্নয়ন ব্যয় ও ভর্তুকিতেও বাজেট বাড়ছে। পাশাপাশি এই বাজেটের বাস্তবিক দিকগুলোর প্রভাবও রয়েছে।
মূল প্রবন্ধে তিনি যেসব তথ্য তুলে ধরেছেন তার সবগুলোই সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের উল্লেখ করে তিনি বলেন, সরকারের অনেক তথ্যের গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন আছে। তারপরও সেটি নিয়ে কাজ করতে হয়েছে। ২০২১ সালের পর থেকে সরকারের হিসাবে জিডিপি বেড়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। তবে তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।
সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, বাজেট হলো হিসাব-নিকাশের খতিয়ান। সবচেয়ে বড় কথা হলো সেটা অগ্রাধিকারের খতিয়ান। এখন আমাদের তাহলে অগ্রাধিকার কি হওয়া উচিত। আমাদের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত কর্মসংস্থান সৃষ্টি। আমাদের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত লুটপাট-দুর্নীতি বন্ধ করা। বৈষম্য দূর করা।
তিনি আরও বলেন, এখন দেশে একটি জনপ্রতিনিধিত্বহীন সরকার রয়েছে। যেখানে কোনো স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা নেই। একটা স্বচ্ছতা তৈরি হয় ভোটের মাধ্যমে। প্রতি ৫ বছর পর পর জনগণের কাছে যখন ভোট ভিক্ষা করতে আসে তখন নিম্নমুখী জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠিত হয়। আর জনপ্রতিনিধিত্ব মূলক জবাবদিহিতা হয়। এতে সমান্তরাল দায়বদ্ধতা প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু বর্তমানে দুটোই ভেঙে গেছে।
তিনি বলেন, এগুলো পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করাই এখন আমাদের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। কিন্তু আমাদের যে ছক বাঁধা বাজেট তার মাধ্যমে এগুলো করা যাবে না। আমাদের বাজেট প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, ট্যাক্স রেভিনিউ এটি একটি সুস্পষ্ট প্রতারণা। যেহেতু একটি ছকের বৃত্তের ঘুরছে সুতরাং এ দিয়ে সাধারণ মানুষকে কেবল বিভ্রান্ত করা সম্ভব। তাদের অবস্থার উন্নয়ন সম্ভব নয়।
অধ্যাপক রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদরা কিছুদিন আগেও দেশের অর্থনীতি ও রাজনীতিকে আলাদা করে দেখার চেষ্টা করতেন। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে দেখা যাচ্ছে যেকোনো দেশের অর্থনীতিটা বুঝতে হলে রাজনৈতিক বন্দোবস্তটা বোঝা সবচেয়ে জরুরি। কারণ হলো বাজেটটা একজন রাজনীতিবিদের হাতেই ছেড়ে দেওয়া হয়।
তিনি বলেন, আমাদের প্রথমেই বুঝতে হবে ওয়ান পার্টি ডমিনেন্ট স্টেটে বাজেটটা কেমন থাকে। বাংলাদেশে সরকারের এখন যে অবস্থা তা চালু রাখতে হলে তাকে বখরা বা রেন্ট দিতে হবে। তা না হলে ক্ষমতায় থাকা যাবে না। এটা পৃথিবীতে নতুন কিছু না। এটি সপ্তদশ শতাব্দীতে ফরাসিতে দেখা যায়।এখানে সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য সুবিধা দেয়।
তিনি বলেন, উন্নয়ন ব্যয় পরিমাণটা কমে গেছে। আগে একটি রাস্তা করবেন তারপরে তার কমিশন পাবেন। কিন্তু এখন জাতীয় গ্রিডে কোনো টাকা দিবেন না কিন্তু খাবেন। অর্থাৎ একটি সরকারের জনভিত্তি যত কমতে থাকবে বখরা ততো সহজ হবে।
উন্নয়ন অর্থনীতি-বিষয়ক গবেষক জিয়া হাসান বলেন, একজন ব্যবসায়ী যদি সরকারকে টাকা না দিয়ে সরকারি কোনো কর্মচারীকে টাকা দেন সেটা কিন্তু ট্যাক্স নয়। সেটা একটা আনঅফিসিয়াল লেনদেন। এতে কিন্তু ট্যাক্স টু জিডিপি বাড়ছে না। যে কারণে আইএমএফ আমাদের সেটি বাড়াতে বলেছে। এতে করে আমাদের দৈনন্দিন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে।
কলামিস্ট ডা. জাহেদ উর রহমান বলেন, বাজেটের একটা দার্শনিক দিক রয়েছে। বাজেটের একটি পপুলিজমও রয়েছে। যার মাধ্যমে একটি সরকার তার জনগণের কাছে যেতে চায়। কিন্তু আমাদের যে বাজেটটি সম্প্রতি পাস হলো সেখানে এই বিষয়টিও আমি দেখিনি। এটি করতে যে খুব বেশি টাকা লাগতো, সেটাও কিন্তু না।
তিনি বলেন, সরকার বলছে, এবারের বাজেট মুদ্রাস্ফীতি কমানোর বাজেট। ধরুন সরকার সামাজিক নিরাপত্তা খাতের বাজেট দিয়েছে। যার মধ্যে সরকার মুক্তিযোদ্ধার ভাতাসহ আরও অনেক কিছু ঢুকিয়ে বেশি দেখায়। আমি সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টি বলতে বুঝাতে চাই বিধবা ভাতা, বয়স্ক ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা এসব। এখানেও সরকার টাকা বাড়ায়নি। যেখানে ১০ শতাংশ মুদ্রাস্ফীতি রয়েছে সেখানে এই মানুষগুলো যারা মাসে ৬০০ টাকা করে পায়, তাহলে তাদের হাতে কত টাকা থাকলো? তার মানে সরকারের মধ্যে পপুলিজমের চেষ্টাও কিন্তু নেই।
তিনি বলেন, আমি সিরিয়াসলি বাংলাদেশকে একটা অলিগার্কি মনে করি। সরকার বাজেটে এই অলিগার্কির হাতেই দেশ তুলে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। যেহেতু তাদের ভোট নাই। সেহেতু তারা একটা জায়গায় নজর দিতে চেয়েছে যে, জনগণ যাতে রাস্তায় না নামে।