সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের নিবন্ধ
হাসিনাকে আশ্রয় দিয়ে ভারত কি তার দক্ষিণ এশিয়ার মিত্রদের হারাচ্ছে?
আউটলুক ডেস্ক
প্রকাশ: ১৫ আগস্ট ২০২৪, ০৬:২৪ পিএম
গণঅভ্যুত্থানের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন শেখ হাসিনা। এটি নয়াদিল্লির ‘প্রতিবেশী প্রথম’ নীতি নিয়ে উদ্বেগ বাড়িয়েছে। এর ফলে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর ওপর চীনের প্রভাব বাড়তে পারে। ওয়াশিংটনের ইস্ট-ওয়েস্ট সেন্টারের অ্যাডজান্ট ফেলো নীলান্তি সমরানায়েক বলেছেন, হাসিনার পদত্যাগ দক্ষিণ এশিয়ার ছোট দেশগুলোর সাথে ভারতের সম্পর্ককে জটিল করে তুলেছে।
নীলান্তি সমরানায়েক মনে করেন, সকল প্রতিবেশী রাষ্ট্রনেতাদের মধ্যে হাসিনার দিল্লির সঙ্গে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ এবং দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ক ছিল। হাসিনার দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া আঞ্চলিক সম্পর্ককে আরও খারাপ দিকে নিয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশ এখন একটি সংস্কার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। নির্বাচনের আগে সেই প্রক্রিয়া শেষ হতে যথেষ্ট সময় লাগবে, তাই অন্তর্বর্তী সরকারের ভারতের সমর্থনের প্রয়োজন হবে।
ভারতের ‘প্রতিবেশী প্রথম’ বিদেশ নীতি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০১৪ সালে শুরু করেছিলেন, যার লক্ষ্য দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক জোরদার করা। বাংলাদেশের অন্যতম রাজনৈতিক দল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী ঐতিহ্যগতভাবে ভারতের পরিবর্তে চীন ও পাকিস্তানের সাথে বেশি ঘনিষ্ঠ। প্রতিরক্ষা সহযোগিতায় বাংলাদেশে চীনের প্রভাব বিশেষভাবে শক্তিশালী। মে মাসে পিপলস লিবারেশন আর্মি বলেছিল, তারা বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সাথে একটি যৌথ সামরিক মহড়া পরিচালনা করবে। ২০১৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের পরে বাংলাদেশ চীনা অস্ত্র রপ্তানির দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রাপক ছিল, যা প্রায় ১১ শতাংশ।
বাংলাদেশের পরিস্থিতির জেরে ভারতের আঞ্চলিক কূটনীতি একের পর এক ধাক্কা খাচ্ছে।
২০২২ সালে শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সঙ্কটে সহায়তা করার পরে, ভারত একটি চীনা পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি প্রকল্প অবরুদ্ধ করে এবং নিরাপত্তার উদ্বেগের কথা উল্লেখ করে শ্রীলংকায় নোঙর করা চীনা গবেষণা জাহাজে আপত্তি জানায়। তবে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে যখন মোদি ভারতের সাম্প্রতিক সাধারণ নির্বাচনের আগে কাচাথিভু দ্বীপের উপর অধিকার দাবি করে একটি রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব পুনরুজ্জীবিত করেছিলেন। যা ভারতের কংগ্রেস পার্টি ১৯৭৪ সালে শ্রীলঙ্কার কাছে হস্তান্তর করেছিল। মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহামেদ মুইজ্জু যিনি ভারত-বিরোধী প্ল্যাটফর্মে প্রচারণা চালিয়েছিলেন। তিনি ক্ষমতায় আসার পর প্রথমেই ভারতীয় সৈন্যদের দেশ থেকে বহিষ্কার করেন। চীনের সাথে আরও শক্তিশালী সম্পর্ক তৈরি করেন।
নেপালের কে.পি. শর্মা অলি, যাকে চীনপন্থি বলে মনে করা হয় এবং আগে আঞ্চলিক বিরোধ নিয়ে ভারতের সাথে যাঁর দ্বন্দ্ব ছিল, তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ফিরে এসেছেন। ২০২১ সালে তালেবান পুনরায় ক্ষমতায় আসার পর থেকে আফগানিস্তানের সাথে ভারতের সম্পর্কও উত্তেজনাপূর্ণ।
সমরানায়েক বলেন, এই চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য ছোট দেশগুলির সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক খুব একটা খারাপ নয়। ভুটান ভারতের সাথে সবচেয়ে বেশি জোটবদ্ধ। যদিও অনেকে মালদ্বীপের বিদেশি সামরিক উপস্থিতি বন্ধ করার এবং প্রতিরক্ষা কার্যক্রমের জন্য তার অভ্যন্তরীণ নীতির সমালোচনা করেছে, তবুও নতুন সরকার একটি সংশোধিত আকাশ নিরাপত্তা সহযোগিতা কর্মসূচিতে ভারতের বেসামরিক উপস্থিতি গ্রহণ করতে ইচ্ছুক ছিল।
সমরানায়েক আরও বলেন, শ্রীলঙ্কা অন্যান্য ছোট দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মতো ভারতের সাথে অসম ক্ষমতার মুখোমুখি হয়েছিল এবং প্রায়শই ভারতের সামনে নিজেকে দুর্বল বলে মনে করতো । উদাহরণ দিতে গিয়ে সমরানায়েক বলেন, শ্রীলঙ্কার বন্দরে যে পরিমাণ জাহাজ নোঙর করার এবং রাজস্ব সংগ্রহের সুযোগ ছিল, শুধুমাত্র চীনা জাহাজ নিয়ে ভারতের উদ্বেগের কারণে সেই কার্যক্রম ১২ মাসের জন্য স্থগিত রাখতে হয়।
তিনি আরও বলেন, সেপ্টেম্বরে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ভারতের ‘প্রতিবেশী প্রথম’ নীতিতে আরো কিছুটা ধাক্কা দিতে পারে । কারণ বামপন্থী এনপিপি (ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ার অ্যালায়েন্স) এর সম্ভাব্য বিজয় ভারত, চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি শ্রীলংকার বৈদেশিক নীতির অভিমুখকে যথেষ্ট অনিশ্চয়তার মুখে ফেলবে।
সিঙ্গাপুরের আইএসইএএস-ইউসুফ ইশাক ইনস্টিটিউটে প্রকাশিত স্টেট অফ সাউথইস্ট এশিয়া ২০২৪ সমীক্ষা অনুসারে, ভারত দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলির অ্যাসোসিয়েশনের মধ্যে সবচেয়ে কম কৌশলগতভাবে প্রাসঙ্গিক অংশীদারদের মধ্যে একটি, যখন চীনকে এই অঞ্চলের সবচেয়ে প্রভাবশালী অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং কৌশলগত শক্তি হিসাবে দেখা হয়। জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত জরিপে অংশ নেওয়া ১০টি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশের ১৯৯৪ জন উত্তরদাতাদের মধ্যে মাত্র ০.৬ শতাংশ বলেছেন যে ভারত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে প্রভাবশালী অর্থনৈতিক শক্তি, যেখানে চীনের দিকে রয়েছে ৫৯.৫ শতাংশ।
ভারতের অর্থনীতিবিদ ও গবেষক নাতাশা আগরওয়াল বলেন, চীনের মতো ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক শক্তির সাথে তুলনা করলে দেখা যাবে তার প্রতিবেশীদের প্রতি দিল্লির দৃষ্টিভঙ্গিতে স্থান পেয়েছে ‘অহংকার’। নাতাশার পরামর্শ, এই অঞ্চলে চীনের উপস্থিতি ঠেকাতে গেলে ভারতকে তার প্রতিবেশী প্রথম নীতিতে সামঞ্জস্য আনতে হবে । স্বাধীন এবং সম্মিলিতভাবে ভারত ও চীনের অর্থনৈতিক প্রভাবের পরিপ্রেক্ষিতে, সম্ভবত ভারতের জন্য তার প্রতিবেশী প্রথম নীতিকে পুনরায় সংজ্ঞায়িত করার সময় এসেছে।
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক অস্থিরতার কারণে ভারতের প্রতিবেশী নীতি কিছুটা টালমাটাল হলেও সময়ের সাথে সাথে সেটি পরিবর্তিত এবং উন্নতির সম্ভাবনা রয়েছে। বলছেন, জিন্দাল স্কুল অফ ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্ত। এই অঞ্চলে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে তার জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়ার জন্য দিল্লিকে অনুরোধ করেছেন শ্রীরাধা। তিনি বলছেন, ভারতকে প্রতিবেশী প্রথম নীতি থেকে বিচ্যুত হলে চলবে না। যেকোনো পরিস্থিতিতেই সেই নীতি মেনে চলতে হবে। এমনকি কঠিন পরিস্থিতিতেও ভারতকে দেখতে হবে প্রতিবেশীদের সাথে কতটা ভালো কাজ করা যায়। এমনকি ভালো সময়েও চীনের দিক থেকে যে চ্যালেঞ্জগুলি আসতে পারে সে বিষয়ে ভারতকে সচেতন থাকতে হবে।
১৯৮৬ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রথম সচিব হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন প্রাক্তন কূটনীতিক অনিল ত্রিগুনায়াত। তিনি বলেন, প্রতিবেশী প্রথম নীতির বিষয়বস্তু এবং প্রয়োগের ক্ষেত্রে অসামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। ভারতের এই নীতির লক্ষ্য হওয়া উচিত প্রতিবেশীদের বৃদ্ধি, উন্নয়ন এবং সক্ষমতা তৈরি করা। ভারত বিশ্বাস করে যে, নিজেদের স্বার্থেই প্রতিবেশীদের সাথে সম্পর্ক দৃঢ় করা উচিত। যাতে সীমান্ত অঞ্চলগুলি জঙ্গিবাদ এবং সন্ত্রাসবাদের মতো ভারতবিরোধী কার্যকলাপের জন্য ব্যবহৃত না হয়। এটি একটি উইন-উইন পার্টনারশিপ।
ত্রিগুনায়াত আরও বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান এবং সম্ভবত পরবর্তী নেতৃত্বের মধ্যে পূর্বপরিকল্পিত কিছু ধারণার কারণে ভারতের প্রতি স্বল্প সময়ের জন্য নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হতে পারে। তবে ঢাকার সাথে ভারতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উভয় দেশের জনগণের ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক সংযোগের ওপর ভিত্তি করে। তাই যেকোনো মন কষাকষি দীর্ঘদিন স্থায়ী হবে না। '
বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক স্কট লুকাস বলেন, ভারতের আঞ্চলিক অবস্থান শেষ পর্যন্ত নির্ভর করে তার নিজস্ব স্থিতিশীলতা এবং অগ্রগতির ওপর। তাই আঞ্চলিক পরিবর্তন সত্ত্বেও যদি ভারতে একটি স্থিতিশীল সরকার থাকে এবং দেশ রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে ক্রমাগত উন্নতি করতে থাকে, তাহলে আপনার সামনে সেরা সুযোগগুলো আবারও ফিরে আসবে।
'উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যের প্রয়োজনীয়তার কারণে আঞ্চলিক দেশগুলো এখনও ভারতের সাথে কাজ করতে আগ্রহী। আপনি যদি এই অঞ্চলের চারপাশে তাকান, এমনকি চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব এবং উপস্থিতি সত্ত্বেও, তাহলে দেখতে পাবেন এখনও এমন অনেক দেশের সরকার রয়েছে যারা চীন এবং ভারতের সাথে সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখতে আগ্রহী এবং অনেক ক্ষেত্রে ভারতের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে চায় তারা।
কুগেলম্যান মালদ্বীপের প্রসঙ্গ তুলে বলেন, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে দিল্লির উদ্বেগের প্রতি আরও সহনশীল অবস্থান গ্রহণ করেছে দেশটি এবং সপ্তাহান্তে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে ‘গভীর’ করার জন্য ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সফরকে স্বাগত জানিয়েছে।বাংলাদেশের পরিস্থিতি এখনও ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ উপস্থাপন করতে পারে। তবে বাণিজ্য এবং পানি বণ্টনের মতো ব্যবহারিক বিষয়গুলো উভয়ের মধ্যে একটি কার্যকর সম্পর্ক পরিচালনার মাধ্যম হতে পারে।