বাগেরহাটে মুসলিম ব্যক্তিদের বাড়িতে আগুনের ঘটনাকে হিন্দুদের বাড়িতে আগুন দাবিতে প্রচার
রিউমর স্ক্যানার
প্রকাশ: ১০ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:৪৬ পিএম
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে একটি ভিডিও প্রচার করে বাগেরহাট বিষ্ণুপুরে হিন্দুদের বসতবাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে।
এক্সে ‘হিন্দুদের বাড়িতে মুসলিমরা আগুন দিয়েছে’ দাবিতে, এবং ফেসবুকে ‘বাগেরহাটে হিন্দু পল্লিতে আগুন’ দাবি করে ভিডিওটি প্রচার করা হয়েছে। এছাড়াও, ভারতীয় গণমাধ্যম নিউজ১৮ বাংলা এক্স পোস্টের সূত্রে একই ভিডিও প্রচার করে তাদের সংবাদে দাবি করেছে বিএনপির দুই পক্ষের বিরোধে সংখ্যালঘুরা আক্রান্ত হয়েছে।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রচারিত ভিডিওটি বাগেরহাটের বিষ্ণুপুরে হিন্দুদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগের কোনো দৃশ্য নয় বরং, আধিপত্য বিস্তার ও ইউনিয়ন বিএনপির কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের বিরোধের জেরে বসতঘরে অগ্নিসংযোগের দৃশ্যকে উক্ত দাবিতে প্রচার করা হয়েছে। এই ঘটনায় অগ্নিসংযোগের শিকার হওয়া বসতবাড়িগুলো মুসলিম ব্যক্তিদের।
এ বিষয়ে অনুসন্ধানে দেশের মূল ধারার গণমাধ্যম ডিবিসি নিউজের ইউটিউব চ্যানেলে গত ৯ জানুয়ারি “বাগেরহাটে বিএনপির দু’পক্ষের সংঘর্ষ; আগুন দিলো নিজ দলের কর্মীদের বাড়িতে” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি ভিডিও সংবাদ প্রতিবেদন পাওয়া যায়। উক্ত ভিডিও প্রতিবেদনটির শুরুর দিকে ও ১ মিনিট পরবর্তী সময়ে আগুনের একটি দৃশ্য কয়েকবার প্রদর্শিত হয়। উক্ত দৃশ্যের সাথে প্রচারিত ভিডিওটিতে প্রদর্শিত দৃশ্যের সাদৃশ্য পাওয়া যায়।
এই ভিডিও প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ইউনিয়ন কমিটিকে কেন্দ্র করে বিএনপির দুই পক্ষের মধ্যে গত তিন দিন ধরে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয় এবং এক পর্যায়ে নিজ দলের কর্মীদের বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়।
অনুসন্ধানে জাতীয় দৈনিক প্রথম আলোর ওয়েবসাইটে ৯ জানুয়ারি প্রকাশিত একটি সংবাদ প্রতিবেদন পাওয়া যায়। উক্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, “বাগেরহাটে স্থানীয় আধিপত্য ও ইউনিয়ন বিএনপির কমিটি গঠন নিয়ে দুই পক্ষের বিরোধের জেরে ৮টি বসতঘর ভাংচুর-লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এ সময় নারী-শিশুসহ অন্তত ২৫ জন আহত হয়েছেন। ৮ জানুয়ারি সন্ধ্যায় বাগেরহাট সদর উপজেলার বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের কুলিয়াদাইড় গ্রামে ওই ঘটনা ঘটে। এর আগে বিকেল থেকে উভয় পক্ষের মধ্যে একাধিকবার পাল্টাপাল্টি হামলার ঘটনা ঘটে
ওই ঘটনার জেরে সেদিন দুপুরে ও বিকেলে উভয় পক্ষের লোকদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি হামলার ঘটনা ঘটে। এক পর্যায়ে সন্ধ্যার দিকে শতাধিক লোকজন রুহুল আমিন ও তাঁর সাত ভাইয়ের বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করেন। আগুনে রুহুল আমিনদের আটটি বসতঘরসহ গবাদিপশুর গোয়াল, হাঁস–মুরগির ঘর ও খড়ের গাদা পুড়ে গেছে।”
এছাড়া, এ বিষয়ে ৯ জানুয়ারি অনলাইন সংবাদমাধ্যম বাংলা ট্রিবিউনে প্রকাশিত সংবাদ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, “দলীয় ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বিএনপি নেতা মোল্লা মোস্তাফিজুর রহমান ও শেখ রুহুল আমীন গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এরই জের ধরে সন্ধ্যায় শেখ রুহুল আমীনসহ তাদের আট ভাইয়ের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করা হয়। ঘটনার পর পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে ছুটে যান। বিএনপির বিবাদমান দুই পক্ষের মধ্যে ফের সংঘর্ষের আশঙ্কায় অতিরিক্ত পুলিশ ও সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। হামলায় উভয় পক্ষের গুরুতর আহতদের মধ্যে বাগেরহাট হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন শেখ সায়েল উদ্দিন (৬০), লিটন শেখ (২৫), মামুন মোল্লা (৪২), কেরামত আলী (৩৮), রোজিনা বেগম (৪৫)। আশঙ্কাজনক অবস্থায় মাহমুদ মোল্লাকে (৪৮) খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
বাগেরহাট সদর উপজেলা বিএনপির সদস্য শেখ রুহুল আমীন বলেন, ‘বুধবার দুপুরে বিষ্ণুপুর ইউনিয়ন বিএনপি কমিটি গঠন সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে জেলা বিএনপির সভাপতি আকরাম হোসেন তালিমের সঙ্গে কথা বলে বাড়ি ফেরার পথে কুলিয়াদাইড় গ্রামের ভিআইপি মোড়ে পৌঁছালে প্রতিপক্ষ মোল্লা মোস্তাফিজ রহমান গ্রুপের নেতাকর্মীরা আমাদের ওপর হামলা চালান। এ সময়ে আমার পক্ষের কয়েকজন আহত হন।’ বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের বিএনপির সভাপতি মোল্লা মোস্তাফিজুর রহমান গ্রুপের নেতা মাসুম মোল্লা বলেন, আমাদের ওপর হামলার ঘটনায় থানায় অভিযোগ দিতে আসার পথে শেখ রুহুল আমীন গ্রুপের লোকজন বিকালে আবারও হামলা চালান। এতে আমাদের পাঁচ জন আহত হন। এ ঘটনার জের ধরে সন্ধ্যায় উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এ সময়ে রুহুল আমীন ভাইসহ আমাদের আট ভাইয়ের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করা হয়।’”
রিউমর স্ক্যানার এসব সংবাদ প্রতিবেদন এবং নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলোর বরাতে পাওয়া তথ্যগুলো বিশ্লেষণ করে দেখেছে, উক্ত ঘটনায় হিন্দুদের বাড়িঘরে আগুন লাগানোর ঘটনা ঘটেনি। এ ঘটনায় রুহুল আমিন এবং তার ভাইদের বাড়িতে আগুন লাগানো হয়েছে, যারা মুসলিম ধর্মাবলম্বী।
এছাড়া, বাগেরহাটের পুলিশ সুপার মো. তৌহিদুল আরিফ রিউমর স্ক্যানারকে বলেছেন, উক্ত ঘটনাটি সাম্প্রদায়িক বা হিন্দুদের লক্ষ্য করে হিন্দুদের ঘরবাড়িতে আগুন দেওয়ার বিষয়টি গুজব। এখানে আধিপত্য বিস্তার ও ইউনিয়ন কমিটি নিয়ে বিএনপির দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে এই আগুনের ঘটনাটি ঘটে। এতে কোনো সাম্প্রদায়িক সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি।
বিষয়টি নিয়ে রিউমর স্ক্যানার বাগেরহাট সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সাইদুর রহমানের সাথেও কথা বলেছে। উক্ত ঘটনায় কোনো হিন্দু ধর্মাবলম্বীর বাড়িতে আগুন ধরানো হয়নি বলে তিনি নিশ্চিত করেছেন।
সুতরাং, বাগেরহাটের বিষ্ণুপুরে হিন্দুদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে বলে প্রচারিত দাবিটি মিথ্যা।