বাংলাদেশ কী এখন তার নিরাপত্তা নিয়ে সচেতন হবে?

সুবাইল বিন আলম, ড. খান সুবায়েল বিন রফিক, মেজর (অব.) শাফায়াত আহমদ
প্রকাশ: ১৬ আগস্ট ২০২৫, ০৭:২৯ পিএম

বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে যুক্ত করা রাডার ‘জিএম ৪০৩এম’। ছবি: সংগৃহীত
ইরানে ইসরায়েলের হামলার পর সারা দেশের সব জায়গাতে এই নিয়ে আলোচনা চললো। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, এত এত বিশ্লেষণের মধ্যে আমরা যে এই হামলা থেকে নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে সতর্ক হতে পারি, সেই জিনিস নিয়ে কারো কোন কথা নাই।
ইসরায়েলের মোসাদের সব মুসলিম দেশেই অপারেশন আছে। এটা বাস্তবতা। একটা কথা বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষই জানে না, সেটা হলো—বাংলাদেশকে সর্বপ্রথম স্বীকৃতি দিয়েছিলো ইসরায়েল, যা আমাদের সেই সময়ের সরকার গ্রহণ করে নাই। সেই সময় থেকেই বাংলাদেশ নিয়ে তাদের আগ্রহ। এখনো বাংলাদেশের অনেক বিদেশি ঋণ আসে ইসরায়েলি ফিনান্স থেকে অন্য দেশ ঘুরে। এরকম প্রোডাক্টও আসে। এই দেশে তাদের নিজস্ব এজেন্ট নাই, এটা বিশ্বাস করার মতো না। এখন আমরা কি সেই ব্যাপারে সতর্ক?
এখন এস্পিওনাজ জগতে ইসরায়েলি প্রযুক্তি দিয়ে সবাইকে ঘায়েল করে ফেলেছে। সিরিয়ার আর্মি, লেবানন বা ইরানে তাদের আক্রমণের সব কিছুতেই ছিল তাদের ডিসগাইজড গ্যাজেট। এখন আমাদের সব সামরিক বাহিনীর গ্যাজেটগুলো কি টেস্ট করা হয়েছে? তবে একটা জিনিস ধরে নিতে পারেন—আমাদের আড়িপাতার বেশিরভাগ যন্ত্রপাতিই ইসরায়েলি প্রযুক্তিনির্ভর। সুতরাং যা রেকর্ড হচ্ছে, তার কপি তাদের সার্ভারে যাওয়ার সম্ভাবনা ৯০ শতাংশের বেশি। কর্মকর্তারা যেন ব্ল্যাকমেইলের শিকার না হন—এটাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সতর্কতার জায়গা।
এরপর আসে ইরানের মতো পরিস্থিতি। ইরানে প্রথম ধাক্কা আসে দেশের অভ্যন্তরে স্যাবোটাজের মাধ্যমে। যেখানে বিদেশি গুপ্তচরের সাথে একটা বড় অংশ ছিল নিজের দেশের মানুষ যারা অনেকেই তাদের পলাতক সাবেক শাসক রেজা পাহলভীর অনুসারী। আমাদের জুলাই গনঅভ্যুত্থানের পর আমরা কি আমাদের কে পি আই জায়গাগুলোতে এই দেশের ফ্যাসিস্ট সরকারের অনুসারীদের সরাতে পেরেছি? আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে অনেক সরকারি অফিসে সন্দেহজনক আগুন লাগে, যা নিজেদের দুর্নীতি লুকানোর প্রচেষ্টা বলে সবার সন্দেহ ছিল। তারাই ভবিষ্যতে লীগ কখনো কোন চেষ্টা করলে দেশে স্যাবোটাজ করবে না- সেই নিশ্চয়তা কি আছে?জনতার মঞ্চ বা ৬৩ জেলার বোমা হামলার কথা তো আমাদের সবারই মনে আছে। সরকারি অনেক ভালো কাজের চেষ্টা ও সরকারি কর্মচারীদের সহযোগিতা না পাওয়াতে স্থবির হয়ে থাকছে, যা পরে ব্যর্থতা হিসেবেই গণ্য হবে। আর ইরানের ঘটনা তো চোখের সামনেই।
সন্দেহভাজন গুপ্তচর হিসেবে অনেককেই গ্রেপ্তার করেছে ইরান। বিভিন্ন দেশের লোকের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল ভারতের। যেখানে সব সময় প্রতিবেশী দেশের মানুষকে সন্দেহের চোখে দেখা হয়, রাখা হয় সতর্কতা। কিছুদিন আগে সোশ্যাল মিডিয়াতে কিছু পোস্টে দেখা গেলো—আমাদের এমআইএসটিতে এখনো ৪ জন ভারতীয় ফ্যাকাল্টি কর্মরত যারা আবার ভারতীয় সামরিক বাহিনীর সদস্য। এমআইএসটির ওয়েবসাইটে তাদের ছবি ও তথ্য আছে। বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই-এ ভারতীয় গোয়েন্দাদের প্রভাব নিয়ে সন্দেহের কথনা কর্মরত ও অবসরপ্রাপ্ত অনেক সামরিক কর্মকর্তার কাছেই শোনা যায়। দেশের নিরাপত্তার দিকে না দেখে, রাজনীতির দিকেই বেশি মনোযোগ, এই অভিযোগ ও শোনা যায়। অথচ আমাদের সামরিক এবং সরকারি কর্মচারীরা এখনো ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। ভারতে অবস্থা আমাদের থেকে কি খুব ভালো, যে শিখে এসে উন্নয়ন হবে?
আমরা আমাদের মূল রফতানি খাত—গার্মেন্টস—সেই খাতের স্ট্র্যাটেজিক নিয়ন্ত্রণও বিদেশিদের হাতে তুলে দিয়েছি। যেখানে আমাদের নিজেদের কোম্পানিগুলোর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ার কথা ছিল, সেখানে আমরা নিজেই নিজেদের বাজার তুলে দিয়েছি। মেগা প্রকল্পগুলোতেও ছিল তাদের অবাধ বিচরণ। বিশেষ করে রূপপুর পাওয়ার প্ল্যান্টে জোর করে তাদের কাজ দেয়াটা ছিল দেশের জন্য একটি ভয়ংকর হুমকি। সরকারিভাবে বলা হয় দেশে আড়াই লাখেরও বেশি অবৈধ বিদেশি আছে। কিন্তু তাদের নিয়ে কি সরকার কিছু করেছে?
বিশ্বের সব দেশেই সেনানিবাসে প্রবেশ থাকে নিয়ন্ত্রিত। আমাদের ঢাকা সেনানিবাস এখন এমন জায়গায় পরিণত হয়েছে, যেখানে ইচ্ছা করলেও মানুষ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। কিন্তু কচুক্ষেত, বনানী, ডিওএইচএস এলাকায় বিদেশিদের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। আগে তো সেনানিবাসের গেটে লেখা থাকতো—বিদেশিদের প্রবেশ নিষেধ। এখন তাও নেই।
এর মাঝে একটি ভয়ঙ্কর উপেক্ষিত বিষয় হলো—সাইবার নিরাপত্তা। ভবিষ্যতের যুদ্ধ হবে তথ্যের। আমাদের দেশের সব বড় কোম্পানির ডেটা সেন্টার অবস্থিত ভারতে। এই সরকার আসার পর অনেকবার আলোচনা উঠলেও এখনো কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। অনেক সরকারি সফটওয়্যার বানানো হয়েছে ভারতীয় কোম্পানির মাধ্যমে—যাদের ব্যাকআপ সার্ভার ভারতে। আপনি ভাবুন, যদি ভ্যাট অফিসের সার্ভার ভারতে হয়, তাহলে আমাদের দেশের সব বেসরকারি কোম্পানির তথ্য তাদের হাতের মুঠোয়। এই তথ্য দিয়েই কিন্তু তারা ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে, এমনকি প্রয়োজন হলে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপও করতে পারবে। আমাদের টেলিকম কোম্পানি, যাদের হাতে রয়েছে, বিশাল তথ্যভান্ডার, সেখানেও ভারতীয়রা চাকরি করছে। আমাদের সরকারি বেশিরভাগ কাজে এখনো পারসোনাল ইমেইল বা জিমেইল ব্যবহার করা হয়, এটা যে কতটা ভয়ংকর আমাদের সরকারের কি ধারণা আছে? হিলারী ক্লিনটন অফিশিয়াল কাজে পারসোনাল ইমেইল ব্যবহারের জন্য নির্বাচনে হেরেই গেলো। ২০১৬ সালের বাংলাদেশ ব্যাংক হ্যাকিং কাণ্ডে সাইবার নিরাপত্তার ভয়াবহতার এক উদাহরণ আমরা পেয়েছি—যা আজও কারো অজানা নয়। ভারতীয় সফটওয়্যার ও রিমোট অ্যাকসেস সংক্রান্ত বিতর্ক তখনও উঠেছিল। এসব বিষয়ে এখনই তদন্ত হওয়া দরকার—সরকারি ও বেসরকারি উভয় পর্যায়ে।
আরেকটি ভয়াবহ ফাঁক রয়েছে—সোশ্যাল মিডিয়ায় হস্তক্ষেপ। ইসরায়েল, ভারত, এমনকি চীন—সব দেশ এখন সোশ্যাল মিডিয়াকে তথ্যযুদ্ধের প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। ফেসবুক, ইউটিউব ও টুইটারের মাধ্যমে মিথ্যা প্রচার ও প্রোপাগান্ডা দিয়ে জনমত প্রভাবিত করা হচ্ছে। আমাদের দেশে এখনো এ নিয়ে কোন স্পষ্ট রোডম্যাপ নেই, নেই কোনো মিডিয়া মনিটরিং ইউনিট যার ফোকাস থাকবে রাষ্ট্রবিরোধী তথ্যপ্রবাহ বন্ধে। ডাটা সেন্টারগুলো ভারতে হওয়ার ফলে আমাদের ভারত বা ইসরায়েল নিয়ে লেখা পোস্টের রীচ অনেক কমে যায়, অনেকে রেস্ট্রিকশন ও খায়।
যুদ্ধের সময় মিডিয়া যুদ্ধ অনেক বড় ভূমিকা রাখে। সাফটা অনুযায়ী আমাদের চ্যানেল ভারতে চলার অনুমতি না পাওয়ার যোগ্য হলেও, আমাদের দেশে এখনো তাদের সব চ্যানেল চলছে। এসব চ্যানেল আমাদের সংস্কৃতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলছে এবং মিথ্যা প্রচারণায় মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। ওদের দেশে অনুমতি না পেলে আমাদের দেশে ও বন্ধ করতে হবে।
সাম্প্রতিক যতগুলো যুদ্ধ হয়েছে—সবখানেই আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার গুরুত্ব সামনে এসেছে। অথচ কাগজে কলমে আমরা মিয়ানমার থেকেও পিছিয়ে। মাইলস্টোনের দুর্ঘটনা আর ও চোখে আঙুল দিয়ে দিয়ে দেখিয়ে গেলো সব। আমাদের এই ব্যবস্থায় এখনই নজর দেওয়া উচিত। আমাদের যে দুইটা সাবমেরিন আছে, তাও কিন্তু পুরানো কেনা। আরেকটা বিষয় হলো—গবেষণা ও উন্নয়ন (আর এন্ড ডি) খাত। ইরান, পাকিস্তান, তুরস্ক, ভারত—সবাই নিজেদের প্রযুক্তির উপর নির্ভর করে ক্ষেপণাস্ত্র বা ড্রোন বানিয়ে এগিয়ে গেছে। প্রতিবেশী ভারতের গবেষণার জন্য প্রতিরক্ষা বাজেটের প্রায় ১০% বরাদ্দ থাকে।২০২৩ সালে ভারতের প্রতিরক্ষা গবেষণায় বরাদ্দ ছিল ১.৩ বিলিয়ন ডলার, যেখানে বাংলাদেশের সামগ্রিক প্রতিরক্ষা বাজেটই প্রায় তার সমান।আমাদের বাজেটেও অন্তত ‘ন্যাশনাল ডিফেন্স টেকনোলজি ইনোভেশন ফান্ড’ গঠন করে পরিকল্পিত বিনিয়োগ দরকার—নাহলে পিছিয়ে পড়ার ঝুঁকি বাড়বেই। সামরিক পরিকল্পনা সবসময়েই ২০ বছর ভবিষ্যৎ ধরে করতে হয়। আমাদের এখন থেকেই তা শুরু করতে হবে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের বড় সম্পদ ছিল—নদী ও খাল। বিখ্যাত ভারতীয় সামরিক ইতিহাসবিদ জেনারেল ডি কে পালিত বলেছিলেন—বাংলাদেশ হচ্ছে “প্রতিরক্ষাকারীর স্বর্গ”। কিন্তু এখন সেই নদী শুকিয়ে গেছে, খাল দখল হয়ে গেছে। ভারতের বাধগুলো কি কেবলই অর্থনৈতিক না, সামরিক কৌশলও তার পেছনে লুকিয়ে আছে? পানির জন্য পাকিস্তানিদের যুদ্ধকালীন দুরবস্থার প্রত্যক্ষ সাক্ষী ভারত। তিস্তা প্রকল্প বা গঙ্গা ব্যারাজ নিয়ে এই সরকার এখনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি, এমনকি জাতিসংঘের ১৯৯৭ জলপ্রবাহ কনভেনশনেও সই করেনি।
কিছুদিন আগে দক্ষিণ কোরিয়াতে একটি সফরে যেয়ে জানতে পারি, কীভাবে উত্তর কোরিয়া ও চীনের ছায়ায় থেকেও তারা নিরাপদ বোধ করে। তারা বললো, তিনটা বিষয় তাদের নিরাপত্তার ভিত: এক, গবেষণায় বড় বিনিয়োগ; দুই, প্রত্যেক নাগরিকের জন্য বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ; তিন, যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি। আমার সঙ্গে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ বর্ষের অনুবাদক মেয়েটিও সামরিক ট্রেনিং নিয়েছে। যদিও এই ঘাঁটি নিয়ে তাদের ভেতরে মতভেদ আছে, তবুও তারা এটাকে নিজের নিরাপত্তার অংশ হিসেবেই দেখে। আমাদের দেশেও এমন ঘাঁটি নিয়ে কানাঘুষা হয়। এখন যদি নিরাপত্তার ঝুঁকি প্রকট হয়, সরকার ও সামরিক বাহিনী বিষয়টি নতুন করে ভাবতে পারে। তবে হ্যাঁ, আগ বাড়িয়ে বিদেশিদের ঢুকিয়ে দেয়ার বিপদও আছে—সেটা অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে।
গণঅভ্যুত্থানের পর আমাদের দেশের আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে সামরিক বাহিনী অক্লান্তভাবে নিরলস কাজ করছে। দেশের রাজনীতি নিয়েও তাদের চিন্তা করতে হচ্ছে। কিন্তু এই কাজ তো আসলে তাদের না। আমাদের প্রশাসন এবং পুলিশ তার কাজ না করতে পারাতে এখন তাদের এই বাড়তি কাজ এবং যা আসলে আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্যই হুমকি হয়ে যেতে পারে- যেহেতু, তারা তাদের আসল কাজে ফোকাস দিতে পারছে না। এরই মধ্যে একজন মেজর গ্রেফতার হয়েছে, দেশের ভিতর স্যাবোটাজের পরিকল্পনাসহ। এরকম আরও অনেক হুমকি আসবে।
আমাদের দেশের নির্বাচনী আলোচনায় কয়েকবার প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য সামরিক প্রশিক্ষণের কথা বলা হলেও, তা এখনো মূল আলোচনায় আসেনি। অথচ যদি এই ব্যবস্থা চালু করা যায়, তাহলে আমরা নিরাপত্তা তো পাবই, পাশাপাশি একটি ফিট ও ডিসিপ্লিনড জাতি গড়ে উঠবে—যারা দেশের প্রতি নিবেদিত থাকবে। টেকসই উন্নয়নের জন্য এমন জনগোষ্ঠীর বিকল্প নেই।
সুবাইল বিন আলম, টেকসই উন্নয়ন বিষয়ক লেখক।
ড.খান সুবায়েল বিন রফিক, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এবং গবেষক।
মেজর (অব.) শাফায়াত আহমেদ, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এবং লেখক।