Logo
Logo
×

বিশ্লেষণ

প্লাস্টিক সংকটে বিপর্যস্ত বিশ্ব, জন্ম থেকে বার্ধক্য পর্যন্ত ক্ষতি প্রতি বছর ১.৫ ট্রিলিয়ন ডলার

ডেস্ক রিপোর্ট

ডেস্ক রিপোর্ট

প্রকাশ: ০৪ আগস্ট ২০২৫, ১২:০৮ পিএম

প্লাস্টিক সংকটে বিপর্যস্ত বিশ্ব, জন্ম থেকে বার্ধক্য পর্যন্ত ক্ষতি প্রতি বছর ১.৫ ট্রিলিয়ন ডলার

প্লাস্টিক নিয়ে বিশ্ব এক ভয়ংকর সংকটে পড়েছে, যা আমাদের শরীর ও প্রকৃতির ওপর জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রভাব ফেলছে। চিকিৎসাবিষয়ক আন্তর্জাতিক পত্রিকা দ্য ল্যানসেট-এ প্রকাশিত এক পর্যালোচনায় বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই সংকটের পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ হলো গত কয়েক দশকে প্লাস্টিক উৎপাদনের ভয়াবহ বৃদ্ধি। ১৯৫০ সালের তুলনায় এখন প্লাস্টিক উৎপাদন বেড়েছে দুই শত গুণের বেশি। এই হার অব্যাহত থাকলে ২০৬০ সালের মধ্যে বছরে এক বিলিয়ন টনের বেশি প্লাস্টিক তৈরি হবে।

বিশ্বে এখন পর্যন্ত আট বিলিয়ন টনেরও বেশি প্লাস্টিক ছড়িয়ে পড়েছে। তা পাওয়া গেছে হিমালয়ের চূড়া থেকে সমুদ্রের গভীর খাদ পর্যন্ত। এর মধ্যে রিসাইক্লিং হয় মাত্র ১০ শতাংশেরও কম। সবচেয়ে বেশি উৎপাদন হয় একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক, যেমন পানির বোতল, ফাস্ট ফুডের প্যাকেট, যা দ্রুত পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে।

এই প্লাস্টিকের কারণে মানুষের স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয় প্রতিটি ধাপে—জ্বালানি উত্তোলন থেকে শুরু করে উৎপাদন, ব্যবহার ও ফেলে দেওয়ার মধ্য দিয়ে। এতে বাতাস দূষিত হয়, বিষাক্ত রাসায়নিক শরীরে প্রবেশ করে, এমনকি মাইক্রোপ্লাস্টিক শরীরের ভেতরে জমতে থাকে। ফেলে দেওয়া প্লাস্টিকে জমা হওয়া পানিতে মশার জন্মও বাড়ে, যেগুলো রোগ ছড়াতে সাহায্য করে।

বিশেষজ্ঞ ফিলিপ ল্যান্ডরিগান বলেন, আমরা জানি প্লাস্টিক কীভাবে মানুষের শরীর এবং প্রকৃতিকে ক্ষতি করে। তিনি মনে করেন, যেহেতু এই সমস্যার বোঝা সবচেয়ে বেশি পড়ে শিশুদের ওপর, তাই এখনই ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

এই পর্যালোচনা এমন এক সময়ে প্রকাশ পেল, যখন বিশ্বের দেশগুলো একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি তৈরির শেষ ধাপে রয়েছে, যার উদ্দেশ্য প্লাস্টিক সংকট মোকাবিলা করা। তবে এতে মতবিরোধ তৈরি হয়েছে। ১০০টির বেশি দেশ চায়, প্লাস্টিক উৎপাদনে সীমা টানতে হবে। কিন্তু সৌদি আরবসহ কিছু পেট্রো-রাষ্ট্র এতে রাজি নয়।

প্লাস্টিক শিল্পের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, উৎপাদন কমানো নয়, বরং রিসাইক্লিং বাড়ানোই সমাধান। কিন্তু গবেষণা বলছে, প্লাস্টিকের রাসায়নিক গঠন এত জটিল যে এগুলো সহজে পুনর্ব্যবহার করা যায় না। কাগজ, কাচ, স্টিল, অ্যালুমিনিয়ামের মতো নয় প্লাস্টিক, যেটিকে রিসাইক্লিং করে সমস্যার সমাধান করা যাবে।

প্লাস্টিক তৈরির ৯৮ শতাংশই হয় কয়লা, গ্যাস ও তেল থেকে। উৎপাদনের সময় প্রচুর জ্বালানি খরচ হয়, যা জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী। শুধু এই শিল্প থেকেই বছরে যে পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ হয়, তা রাশিয়ার পুরো নিঃসরণের চেয়েও বেশি।

অসংখ্য রাসায়নিক ব্যবহার করা হয় প্লাস্টিকে—যেমন রঙ, স্ট্যাবিলাইজার, আগুন প্রতিরোধক উপাদান, ইত্যাদি। অনেক উপাদান মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হলেও কোম্পানিগুলো জানায় না কোন উপাদান তারা ব্যবহার করছে।

গবেষণা বলছে, গর্ভস্থ শিশু, নবজাতক ও ছোট শিশুরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে। প্লাস্টিকের কারণে গর্ভপাত, অকাল প্রসব, মৃত শিশু জন্ম, ফুসফুসের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, জন্মগত ত্রুটি, এমনকি ভবিষ্যতে বন্ধ্যাত্ব পর্যন্ত হতে পারে।

এইসব প্লাস্টিক সময়ের সঙ্গে ছোট ছোট টুকরায় ভেঙে গিয়ে মাইক্রো ও ন্যানোপ্লাস্টিকে পরিণত হয়। এগুলো পানি, খাবার ও বাতাসের মাধ্যমে মানুষের শরীরে ঢুকে পড়ে। এই ক্ষুদ্র কণাগুলো পাওয়া গেছে রক্ত, স্তন্য, গর্ভনালির প্লাসেন্টা, বীর্য ও অস্থিমজ্জায় পর্যন্ত। এখনো জানার অনেক কিছু বাকি, তবে এগুলো স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাকের মতো রোগের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে।

বিজ্ঞানীরা বলেন, অনেকেই প্লাস্টিককে সস্তা জিনিস ভাবেন, কিন্তু স্বাস্থ্যের ক্ষতি হিসাব করলে এটি অনেক ব্যয়বহুল। ৩৮টি দেশে মাত্র তিনটি প্লাস্টিক রাসায়নিক—PBDE, BPA ও DEHP—থেকে স্বাস্থ্যক্ষতির বার্ষিক আর্থিক ক্ষতি দাঁড়ায় প্রায় দেড় ট্রিলিয়ন ডলার।

এই গবেষণা প্রথম ধাপ মাত্র। ভবিষ্যতে আরও ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে। প্রতিবেদনের অন্যতম লেখক মার্গারেট স্প্রিং বলেন, আমরা চাই বিশ্বজুড়ে নীতিনির্ধারকেরা যেন নির্ভরযোগ্য তথ্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। তাই এসব প্রতিবেদন নিয়মিত প্রকাশ করা হবে।

সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান

Logo

ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন