বিএনপির ৩১ দফা
জনমুখী প্রত্যাশা পূরণের মৌলিক বাস্তবতা
-688e17c10414e.jpg)
বর্তমানে বাংলাদেশ এমন এক সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে, যেখানে রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে পরিবর্তনের দাবি জোরালো হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, প্রশাসনিক দুর্বলতা, বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের সব খাতে রাষ্ট্র যেন তার ভারসাম্য হারাতে বসেছে। দীর্ঘ সময়ের গেড়ে বসা ফ্যাসিস্টের চরম অমানবিক রাষ্ট্র সহসাই ঠিক হয়ে যায় না।
অভ্যুত্থানের পরে কতকটা আশ্বস্ত হওয়ার মতো পরিবেশ হয়ত হয়েছে কিন্তু মোটেই তা দীর্ঘ মেয়াদে স্থির নয়। বরং অনিশ্চিয়তার কালো মেঘ বারবার ঘিরে দিতে চাইছে প্রিয় বাংলাদেশের আকাশ। এমন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল—বিএনপি 'রাষ্ট্র মেরামতের ৩১ দফা' নামে একটি ঘোষণাপত্র প্রকাশ করেছে, যা শুধু একটি রাজনৈতিক দলীয় প্রতিশ্রুতি নয়, বরং দেশের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র কাঠামো ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের এক সুস্পষ্ট রূপরেখা। পাশাপাশি জনসাধারণের সামগ্রিক উন্নতি বিধানের সুনির্দিষ্ট প্রতিজ্ঞা।
এই ৩১ দফার মূল সুর হলো—রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে প্রতিহিংসার রাজনীতি দূর করে এমন এক সমাজব্যবস্থা গঠন যেখানে থাকবে সম-অধিকার, ধর্মীয় সহাবস্থান এবং বিচার, গণমাধ্যম ও প্রশাসনে জবাবদিহিতা। এই প্রস্তাবগুলোর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও আলোচিত হলো—নির্বাচনের সময়কালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন। দীর্ঘদিন ধরে দেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিয়ে যে প্রশ্ন ও সংশয় তৈরি হয়েছে, তা নিরসনে এই দাবি নাগরিক সমাজের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন।
বিএনপির প্রস্তাবে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, একটি নিরপেক্ষ, দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনী প্রক্রিয়া কখনোই গ্রহণযোগ্য বা বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে না। পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর নির্বাহী ক্ষমতার উপর নিয়ন্ত্রণ আনয়ন এবং কেউ যাতে টানা দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী থাকতে না পারেন—এমন বিধান সংযোজনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এই প্রস্তাবের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতার কেন্দ্রীভূতকরণ রোধ করা ও ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা উপস্থাপন করা হয়।
আইনের শাসনের অভাবে নাগরিক অধিকার যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, বিএনপি সেখানে জনবান্ধব দৃঢ় একটি অবস্থান নিয়েছে। গুম, খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অবসান ঘটানো এবং মানবাধিকার বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি ৩১ দফায় সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে। একটি কার্যকর প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন, মিডিয়া কমিশন এবং অর্থনৈতিক সংস্কার কমিশন গঠনের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে। এসব উদ্যোগ দেশের দুর্নীতিগ্রস্ত ও দলীয়করণে নিমজ্জিত অনৈতিক ব্যবস্থার চিরস্থায়ী অবসান ঘটাবে এবং দেশে নতুন আশার আলো জ্বালাবে।
ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সহিষ্ণুতার প্রশ্নে ‘ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার’—বিএনপি এই নীতিকে গুরুত্ব দিয়েছে। সকল ধর্মাবলম্বীর নিজ নিজ ধর্ম পালন এবং তাদের সম্পত্তি ও অধিকার সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি এই প্রস্তাবে জায়গা পেয়েছে, যা একটি বহুধর্মীয় সমাজে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই ৩১ দফা শুধু বর্তমান সংকটের তাৎক্ষণিক প্রতিকারের জন্য নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদী সুশাসন ভিত্তিক একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠনের প্রতিশ্রুতি। দেশের গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর মধ্যে নতুন করে আলোচনার ভিত্তি রচনা করেছে এটি। এই প্রস্তাবে গণতন্ত্র, সুশাসন ও মানবাধিকার নিশ্চিতকরণের যে দিশা দেখানো হয়েছে, তা বাস্তবায়িত হলে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও জবাবদিহিমূলক একটি রাষ্ট্র গঠন সম্ভব হবে। তবে এই মহৎ পরিকল্পনার সফলতা এককভাবে নির্ভর করবে তার বাস্তবায়ন কৌশলের উপর। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো জনগণের আস্থা ও সমর্থন অর্জন। রাজনীতিতে আস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে শুধু কাগুজে প্রতিশ্রুতি নয়, প্রয়োজন সততা নির্ভর আন্তরিকতা, সদিচ্ছা ও দৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার।
বিএনপির ৩১ দফা রূপরেখা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত সময়োপযোগী, সাহসী এবং জনমুখী উদ্যোগ। গণমানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতিধ্বনি হিসেবে প্রতিফলিত হয়েছে তা। কল্যাণমুখী, ন্যায়ভিত্তিক ও সমতানির্ভর একটি রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখাতে সক্ষম হয়েছে ৩১ দফা। এখন দেখার বিষয়, এই দফাগুলোর ভিত্তিতে জাতি কতটা একতাবদ্ধ হতে পারে এবং রাষ্ট্র সংস্কারের পথে কতটা বাস্তব অগ্রগতি সম্ভব হয়। জনমুখী ৩১ দফা নিয়ে ইতোমধ্যে বিভিন্ন সভা, সেমিনার হয়েছে এবং চলমান রয়েছে। জনগণের সামনে এই ৩১ দফা থেকে মোটাদাগে কয়েকটি দফা তুলে ধরলে তা নির্বাচনের মাঠে ম্যানিফেস্টো হিসেবেও চিহ্নিত হতে পারে।
কৃষকের পেনশন ও স্বাস্থ্যসেবা কার্ড : মর্যাদার জীবনের এক নতুন দিগন্ত
বাংলাদেশ অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্রে যাঁরা আছেন—তাঁরা হলেন দেশের কৃষকসমাজ। এই শ্রেণির নিরলস পরিশ্রম, ধৈর্য ও সংগ্রামের ফলেই দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার পথে এগিয়ে চলেছে। অথচ সেই কৃষকরাই থেকে গেছেন রাষ্ট্রের মূলস্রোতের বাইরে। আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তায় যেখানে নাগরিক কল্যাণের ধারাবাহিক উদ্যোগ জায়গা পেয়েছে, সেখানে কৃষকদের জন্য একটি টেকসই ও মানবিক নীতির প্রবর্তন এখন সময়ের দাবি। এ প্রেক্ষাপটেই কৃষকদের জন্য পেনশন ও হেলথ কার্ড চালুর প্রস্তাবটি এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হবে।
এখানে প্রথমেই আসে পেনশন ব্যবস্থার কথা। একজন কৃষক যখন যৌবনে মাঠে ঘামে ভিজে দিনরাত কাজ করেন, তখন জাতির খাদ্য নিরাপত্তার ভিত্তি রচনা করেন তিনি। কিন্তু বৃদ্ধ বয়সে সেই কৃষকের জীবনে নেমে আসে অনিশ্চয়তা, অবহেলা ও আর্থিক দুরবস্থা। কাজের সামর্থ্য ফুরালে অনেকেই হয়ে পড়েন পরিবারের বোঝা। এমন বাস্তবতায় কৃষকদের জন্য একটি রাষ্ট্রীয় পেনশন স্কিম চালু করা একান্ত প্রয়োজন। এই পেনশন কেবল অর্থনৈতিক সহায়তা নয়, বরং এটি কৃষকের জীবনে সম্মানের প্রতীক, এক নির্ভরযোগ্য আশ্রয়। বৃদ্ধ বয়সে তাঁদের মুখে হাসি ফোটাবে, আত্মবিশ্বাস জোগাবে এবং পরিবার ও সমাজে তাঁদের মর্যাদা নিশ্চিত করবে এই পেনশন স্কিম।
দ্বিতীয়ত, কৃষকদের জন্য একটি সর্বজনীন হেলথ কার্ড ব্যবস্থা। এটি চালুর করা আজ আর বিলাসিতা নয়, বরং মৌলিক অধিকার হিসেবে বিবেচনা করা প্রয়োজন। প্রতিনিয়ত খোলা মাঠে, রোদে-বৃষ্টিতে পরিশ্রম করতে করতে কৃষকের দেহে ক্লান্তির ছাপ পড়ে, রোগবালাই আঘাত হানে। অথচ চিকিৎসা খরচের ভয়ে অনেকেই হাসপাতালে যেতে সাহস করেন না। হেলথ কার্ডের মাধ্যমে তাঁরা পাবেন নামমাত্র কিংবা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা। এতে তাঁদের জীবনমান উন্নত হবে, ব্যয় কমবে, এবং কর্মক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী হবে। সুস্থ কৃষক শুধু নিজের পরিবারের জন্য নয়, গোটা জাতির জন্যই বিশাল এক সম্পদ।
এই দুই ব্যবস্থা দেশের কৃষকদের সার্বিক উন্নয়নের জন্য একান্ত অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। পেনশন ও হেলথ কার্ড কেবল একটি আর্থসামাজিক নিরাপত্তার বলয় নয়, বরং রাষ্ট্রের প্রতি কৃষকের অবদানের প্রতি আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি। গ্রামীণ অর্থনীতি যা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামোর ভিত্তি, তা কৃষকদের হাত ধরেই শক্তিশালী হয়েছে এবং হবে। তাই তাঁদের জন্য এই নীতিগত সুবিধাগুলো নিশ্চিত করা হলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে অত্যন্ত ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। কৃষকেরা সুস্থ, নিরাপদ ও সম্মানজনক জীবনযাপন করতে পারলে তাঁদের সন্তানরাও কৃষিকাজে আগ্রহী হবে। এতে করে কৃষির ধারাবাহিকতা রক্ষা পাবে, বাড়বে খাদ্য উৎপাদন। টেকসই উন্নয়নের পথে দেশকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিতে এর কোন বিকল্প নেই।
অতএব, কৃষকের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন, সামাজিক নিরাপত্তা ও রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য পেনশন ও হেলথ কার্ড চালু করাকে শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি হিসেবে না দেখে সময়ের দাবি হিসেবে ধরে নিতে হবে। এই নৈতিক দায়িত্ব এবং উন্নত ভবিষ্যতের সুস্পষ্ট রূপরেখা অর্জন করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন নিশ্চিত করবে। কৃষকদের প্রতি সত্যিকার কৃতজ্ঞতা প্রকাশের উপায় একমাত্র এটাই—তাঁদের ঘামঝরা পরিশ্রমের মর্যাদা রাষ্ট্রীয় নীতিতে স্বীকৃতি দিয়ে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করা হবে এখন বিএনপির মৌলিক অগ্রগতি। শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের রাষ্ট্র ভাবনায় কৃষক এবং কৃষি ছিল উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু। অর্থনৈতিক বিপ্লব ঘটাতে কৃষিকে বেছে নিয়েছেন পৃথিবীর সকল মানবতাবাদী নেতৃত্ব। সে হিসেবে কৃষক মূল্যায়িত হয়েছেন নতুন সমাজের অগ্রদূত হিসেবে। তাঁর শারীরিক মানসিক সুস্থতা মানে জাতি হিসেবে বাংলাদেশের জনগণের সুস্থতা।
সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য নতুন বেতন কাঠামো : সময়োপযোগী এক প্রস্তাব
রাষ্ট্র পরিচালনার অন্যতম প্রধান স্তম্ভ হিসেবে সরকারি চাকরিজীবীদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। প্রশাসনের নিচু স্তর থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত তাঁদের নিরবচ্ছিন্ন পরিশ্রম, দক্ষতা ও কর্তব্যনিষ্ঠার মাধ্যমেই রাষ্ট্রের কার্যক্রম সচল থাকে, নাগরিক সেবা পৌঁছে যায় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। অথচ দুঃখজনক হলেও সত্য, বর্তমানে তাঁদের আর্থিক নিরাপত্তা ও সামাজিক মর্যাদা চরম প্রশ্নের মুখে। এর অন্যতম কারণ হলো—অতীতের বেতন কাঠামো এখনকার বাস্তবতা ও প্রয়োজনের সঙ্গে আর মোটেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
প্রচলিত বেতন কাঠামো ২০২৫ সালের প্রেক্ষাপটে এসে একেবারেই অপ্রতুল ও অচল হয়ে পড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, নগরায়ণের কুফল, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, শিক্ষা ও চিকিৎসা ব্যয়ের ব্যাপকতা, পরিবহন ও আবাসন সংকটসহ জীবনের প্রায় প্রতিটি খাতে ব্যয় বহুগুণে বেড়ে গেছে। অথচ সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন কাঠামো সেই বাড়তি ব্যয়ের ভার বহন করতে পারছে না মোটেই, ফলে তাঁরা পড়ছেন গভীর আর্থিক সংকটে। এ অবস্থায় শুধু দক্ষতা বা নিষ্ঠার ওপর ভর করে রাষ্ট্র পরিচালনার স্বপ্ন বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।
এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে এখন সময় এসেছে আধুনিক, বাস্তবমুখী ও মানবিক একটি বেতন কাঠামো প্রবর্তনের। ২০২৫ সালের চাহিদা ও জীবনযাত্রার ব্যয়ের সাথে সামঞ্জস্য রেখে সম্পূর্ণ নতুন একটি বেতন কাঠামো গঠন করা হলে তা সরকারি কর্মচারীদের জীবনমানের উন্নয়নে সরাসরি অবদান রাখবে। শুধু তাই নয়, তাঁদের মাঝে পেশাগত দায়বদ্ধতা ও উৎসাহ বাড়বে, যা একদিকে প্রশাসনিক গতিশীলতা আনবে, অন্যদিকে দুর্নীতির প্রবণতা হ্রাস করবে। কারণ, অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা অনেক সময় কর্মচারীদের অনৈতিক পথে ঠেলে দেয় এবং রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
নতুন বেতন কাঠামোতে বেসিক বেতন বৃদ্ধির পাশাপাশি চাকরির ধরণ, ঝুঁকি, স্থানভেদ এবং দক্ষতার ভিত্তিতে আলাদা ভাতা নির্ধারণ করা যেতে পারে। গ্রামীণ ও দুর্গম অঞ্চলে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য বিশেষ ইনসেনটিভ বরাদ্দ করলে তাঁরা উৎসাহিত হবেন মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে। একইসঙ্গে আবাসন, স্বাস্থ্যসেবা ও সন্তানদের শিক্ষার জন্য আলাদা সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হলে শিক্ষিত এবং দক্ষরা সরকারি চাকরিকে একটি সম্মানজনক ও আকর্ষণীয় পেশা হিসেবে ধরে রাখতে আগ্রহী হবে। নতুন কাঠামো তৈরির ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতের বেতন কাঠামোর সঙ্গে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে একটি ভারসাম্য রক্ষা করা জরুরি, যাতে মেধাবীরা সরকারি খাত থেকে মুখ ফিরিয়ে না নেন। কারণ একটি রাষ্ট্রের উন্নয়নের অন্যতম পূর্বশর্ত হলো দক্ষ ও প্রণোদিত প্রশাসন, যা নির্ভর করে কর্মীদের অর্থনৈতিক সুরক্ষা ও পেশাগত মর্যাদার ওপর।
সবশেষে, এটা মনে রাখতে হবে—সরকারি চাকরিজীবীদের কল্যাণ নিশ্চিত করা মানে শুধু একটি শ্রেণির স্বার্থরক্ষা নয়, বরং তা সমগ্র রাষ্ট্রযন্ত্রের কার্যকারিতা এবং নাগরিকদের সেবার মান উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি। তাই সময় এসেছে পূর্ববতি কাঠামো পর্যালোচনা করে ২০২৫ সালের জন্য আধুনিক, টেকসই ও দৃষ্টান্তমূলক একটি বেতন কাঠামো প্রণয়নের। শুধু বর্তমান নয়, বাংলাদেশের ভবিষ্যতের পথচলাও সুসংহত করবে এই বেতন কাঠামো।
কর্মসংস্থান ও উদ্যোক্তা বিকাশে শিক্ষার্থীদের সহায়তা : একটি সময়োপযোগী জাতীয় অঙ্গীকার
শিক্ষাব্যবস্থা ক্রমাগত বিস্তৃত হচ্ছে, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে প্রতিবছর হাজার হাজার শিক্ষার্থী স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করে বের হচ্ছেন। কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, তাদের একটি বড় অংশ উচ্চশিক্ষার পরেও কর্মসংস্থান কিংবা উদ্যোক্তা হবার পর্যাপ্ত সুযোগ পাচ্ছেন না। ফলে শিক্ষিত বেকারত্বের হার দিন দিন বেড়েই চলেছে, যা শুধু ব্যক্তিগত হতাশা নয়, বরং জাতীয় উন্নয়নের পথেও এক বড় অন্তরায়। এই সংকট মোকাবিলায় এখনই সময় শিক্ষার্থীদের জন্য একটি বাস্তবভিত্তিক, সমন্বিত ও কার্যকর সহযোগিতা পরিকল্পনা বাস্তবায়নের।
পড়ালেখা শেষ করে একজন শিক্ষার্থীর সামনে দুটি পথ খোলা থাকে—একটি হলো চাকরিতে প্রবেশ, অন্যটি উদ্যোক্তা হওয়া। এই দুটি পথেই সরকার বা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে পরিকল্পিত সহায়তা থাকলে শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যৎ গঠনে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠবেন। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েই ‘ক্যারিয়ার গাইডেন্স সেন্টার’ প্রতিষ্ঠা করা জরুরি, যেখানে শিক্ষার্থীদের দক্ষতা মূল্যায়ন, জীবনঘনিষ্ঠ প্রশিক্ষণ এবং কর্মসংস্থানের উপযোগী বিভিন্ন দক্ষতা অর্জনের সুযোগ থাকবে।
চাকরি প্রত্যাশীদের জন্য শিল্প ও বাজারের চাহিদা অনুযায়ী টেকনিক্যাল প্রশিক্ষণ, সফট স্কিল, আইটি জ্ঞান, যোগাযোগ দক্ষতা ও ভাষার উপর নিয়মিত প্রশিক্ষণ চালু করা দরকার। এ ছাড়া বিভিন্ন সেক্টরের সঙ্গে একাডেমিক ইনস্টিটিউশনের সংযোগ স্থাপন করে ইন্টার্নশিপ, ক্যাম্পাস রিক্রুটমেন্ট ও চাকরি মেলায় অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করা উচিত।
যারা উদ্যোক্তা হতে চান, তাদের জন্য প্রারম্ভিক পর্যায়ে seed money, সহজ শর্তে ঋণ, পরামর্শ প্রদান, ব্যবসা পরিচালনা প্রশিক্ষণ, বাজার বিশ্লেষণ ও ব্র্যান্ডিং-সংক্রান্ত সহায়তা প্রদান করা আবশ্যক। উদ্যোক্তা উন্নয়ন কেন্দ্র (Entrepreneurship Development Cell) গঠনের মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থীকে ধারণা থেকে শুরু করে বাস্তবায়ন পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা ও সহযোগিতা প্রদান জরুরি। এতে করে শুধু একটি স্টার্টআপ নয়, নতুন একটি কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র তৈরি হবে, যা অন্য শিক্ষার্থীদেরও অনুপ্রাণিত করবে। শিক্ষার্থীদের কর্মজীবনে প্রবেশের পূর্বেই এ ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা নিশ্চিত করা হলে তা বহুমাত্রিক সুফল বয়ে আনবে। একদিকে কমবে শিক্ষিত বেকারত্ব, অন্যদিকে সৃষ্ট হবে নতুন নতুন শিল্প ও ব্যবসা ক্ষেত্র। এর মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে নবপ্রাণ সঞ্চার হবে, যুবসমাজ রাষ্ট্রের উৎপাদনশীল শক্তিতে পরিণত হবে।
সবশেষে বলা যায়, একটি জাতির সবচেয়ে বড় সম্পদ তার শিক্ষিত তরুণ প্রজন্ম। তাদের সঠিক দিকনির্দেশনা, প্রশিক্ষণ ও সহায়তা না দিলে সেই সম্ভাবনা শুধু নষ্টই হবে না, বরং সমাজে হতাশা, অসন্তোষ ও অপরাধপ্রবণতাও বৃদ্ধি পাবে। সমাজের বোঝা হিসেবে রাষ্ট্রের ঘাড়ে চাপবে দীর্ঘ যন্ত্রণা। তাই এখনই প্রয়োজন, শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা শেষে আত্মনির্ভরশীলতা অর্জনের পথ তৈরি করা—হোক তা চাকরি অথবা উদ্যোক্তা হয়ে। এটি কেবল একটি নীতিগত অঙ্গীকার নয়, বরং একটি আত্মমর্যাদাসম্পন্ন জাতি গঠনের ভিত্তি।
বিধবা নারীর ভাগ্যোন্নয়ন ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ : কল্যাণমুখী রাষ্ট্রের অপরিহার্য অঙ্গীকার
একটি সভ্য ও মানবিক রাষ্ট্রের মূল পরিচয় নিহিত থাকে তার দুর্বল, অবহেলিত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতি দেখানো আচরণে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিধবা নারীরা এমন একটি জনগোষ্ঠী, যারা আজও নানাভাবে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও মানসিক বঞ্চনার শিকার হয়ে থাকেন। তাঁদের জীবনের দুঃখ, নিঃসঙ্গতা ও আর্থিক সংকট যেন নিত্যদিনের বাস্তবতা। তাই বিধবা নারীদের ভাগ্যোন্নয়ন এখন আর শুধু দয়া বা দান নয়—এটি হতে হবে রাষ্ট্রের একটি মৌলিক দায়িত্ব।
বিধবা নারীদের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট ও বিস্তৃত কল্যাণনীতি প্রণয়ন করতে হবে, যার মাধ্যমে তাঁরা আত্মনির্ভরশীল ও সম্মানজনক জীবনে ফিরে যেতে পারেন। বিধবাদের জন্য নিয়মিত সরকারি আর্থিক সহায়তা নিশ্চিত করা উচিত, যেন তাঁরা ন্যূনতম সুবিধা ভোগ করতে পারেন। এ ছাড়া, বয়স ও অবস্থাভেদে ভোকেশনাল বা বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা জরুরি, যাতে তাঁরা নিজ নিজ দক্ষতার ভিত্তিতে উপার্জনক্ষম হয়ে ওঠেন।
কর্মসংস্থানের সুযোগ বিধবা নারীদের আত্মসম্মান ও আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করবে। তাঁদের জন্য গৃহভিত্তিক বা ক্ষুদ্র উদ্যোগভিত্তিক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির পাশাপাশি সহজ শর্তে ক্ষুদ্রঋণ, উপকরণ সহায়তা ও বাজার সংযোগের ব্যবস্থা করলে তাঁরা সমাজের বোঝা নয়, বরং সম্পদে পরিণত হবেন। তাঁদের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আনতে হবে। চিকিৎসা, আবাসন, সন্তানদের শিক্ষাব্যবস্থা ইত্যাদি সুবিধা নিশ্চিত করে একটি সহানুভূতিশীল রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতিফলন ঘটাতে হবে এর মধ্য দিয়ে।
এই উদ্যোগ নারীর ক্ষমতায়নের পথে একটি বাস্তবসম্মত দৃঢ় পদক্ষেপ, যা কেবল তাঁদের ব্যক্তিজীবনেই পরিবর্তন আনবে না, বরং সমাজে মানবিক ও সমতাভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গিরও সূচনা ঘটাবে।
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আনা : রাষ্ট্র সংস্কার ও জন-আকাঙ্ক্ষার দিকদর্শন
দেশের সবথেকে চরম বাস্তবতা হলো—দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি। প্রতিদিনের বাজারে সাধারণ মানুষ, বিশেষত দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি এক ধরনের নীরব যুদ্ধের মুখোমুখি হন। চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজ, ডিম, সবজি—এসব নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে জীবনযাত্রা দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। তাই দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসার অঙ্গীকার শুধু রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি নয়—এটি নাগরিক জীবনের এক মৌলিক দাবি।
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য সর্বপ্রথম বাজার ব্যবস্থাপনায় জবাবদিহিতা আনতে হবে। বাজার তদারকি ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে, যেখানে নিয়মিত অভিযান, নজরদারি এবং প্রকৃত মূল্য নির্ধারণের স্বচ্ছ পদ্ধতি কার্যকর থাকবে। নকল বা মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য বিক্রি এবং পণ্যের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বৃদ্ধির সঙ্গে জড়িত সিন্ডিকেট চক্রকে ভেঙে দিতে হবে কঠোরভাবে। প্রথমবার ধরা পড়া দোষীদের দ্বিতীয়বার আর সুযোগ দেয়া যাবে না। সকল শাস্তির পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্যের লাইসেন্স চিরস্থায়ী ভাবে বাতিল করে দিতে হবে। দেশের আমদানি-রপ্তানি নীতিতে প্রয়োজন অনুযায়ী ভারসাম্য আনতে হবে। কৃষি ও উৎপাদন খাতে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ বাড়িয়ে অভ্যন্তরীণ সরবরাহ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে হবে।
তদুপরি, কালোবাজারি, মজুতদারি ও অস্বচ্ছ বাজার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে অত্যন্ত কঠোর আইন প্রয়োগ সুনিশ্চিত করতে হবে। ন্যায্য মূল্যে পণ্য বিক্রির জন্য রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত বিক্রয় কেন্দ্র (যেমন : টিসিবি) আরও বিস্তৃত করতে হবে। শহর ও গ্রাম—উভয় অঞ্চলের মানুষের সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।
বিধবা নারীদের ভাগ্যোন্নয়ন এবং দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ—পরস্পরসম্পর্কযুক্ত সামাজিক ন্যায়বিচার ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার দুই স্তম্ভ। যখন একজন বিধবা নারী নিশ্চিতভাবে তার সংসার চালাতে পারবেন এবং ন্যায্য মূল্যে পণ্য কিনে বাঁচতে পারবেন, তখনই একটি মানবিক রাষ্ট্রের স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিতে পারে। তাই এসব বিষয়ে রাষ্ট্রের সুদৃঢ় প্রতিশ্রুতি ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ এখন সময়েরই দাবি এবং গণমানুষের প্রত্যাশা। বাংলাদেশের সকল প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কথা বিবেচনায় রেখে রাষ্ট্রকাঠামোর সামগ্রিক উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি রয়েছে বিএনপির ৩১ দফা রূপরেখায়। তাই, সময়োপযোগী, সাহসী এবং উল্লেখিত জনমুখী উদ্যোগসমূহ সামনে এনে সহজ-সরল নির্বাচনী ম্যানিফেস্টো প্রকাশ এখন বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের প্রাণের দাবি।