Logo
Logo
×

বিশ্লেষণ

দ্য ওয়্যার প্রতিবেদন

‘তুমি বাংলা বলো, তাহলে তুমি বাংলাদেশি’—দিল্লির মুসলিম পরিবারগুলো চরমভাবে পুলিশি হয়রানির শিকার

Icon

অতুল অশোক হাওয়ালে

প্রকাশ: ২৬ জুলাই ২০২৫, ০১:১০ পিএম

‘তুমি বাংলা বলো, তাহলে তুমি বাংলাদেশি’—দিল্লির মুসলিম পরিবারগুলো চরমভাবে পুলিশি হয়রানির শিকার

দিল্লির বাওয়ানার জে জে কলোনির বস্তিতে নিজেদের ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। ছবি: অতুল অশোক হাওয়ালে।

গত কয়েক মাসে ভারতের নানা শহরের বস্তি এলাকা থেকে জোরপূর্বক উচ্ছেদ এবং বেআইনি অভিবাসী থাকার অভিযোগে মানুষজনকে ধরে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা অনেক বেড়েছে। বিশেষ করে মুসলিম এবং বাংলা ভাষাভাষীদের “অবৈধ নাগরিক” হিসেবে চিহ্নিত করে ‘হোল্ডিং সেন্টার’ নামের স্থানে রাখার প্রক্রিয়া এক ভয়ংকর রূপ নিয়েছে।

দিল্লির মতো শহর গড়ে তোলার পেছনে যারা শ্রম দিয়েছে, যারা দিনরাত পরিশ্রম করে ঘর, রাস্তা, বিল্ডিং বানিয়েছে, সেই প্রান্তিক মানুষগুলো এখন হঠাৎ করে নিজেদের নাগরিকত্ব নিয়েই প্রশ্নের মুখে পড়ছে।

দিল্লির বাওয়ানার জে জে কলোনির বাসিন্দা ৫৪ বছর বয়সী সাজন বললেন, “মন্দিরে গেলে প্রসাদ দিতে হয়।” কথাটা ধর্ম নিয়ে নয়, বরং পুলিশের হাতে মার খাওয়াকে তিনি এমন করে ব্যঙ্গ করলেন। তাঁর কথায়, “এখন প্রসাদ দেওয়া মানে থানায় গিয়ে হেনস্তা হওয়া, অপমান হওয়া।”

দিল্লির আশপাশে বসবাসকারী নিম্নআয়ের বহু মুসলিম পরিবার, যারা বহু বছর আগে পশ্চিমবঙ্গ, বিহার কিংবা ঝাড়খণ্ড থেকে জীবিকার টানে এখানে এসেছেন, এখন ‘বাংলাদেশি’ অপবাদে আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন।

বাওয়ানার জে জে কলোনির বহু বাসিন্দা অভিযোগ করেছেন, তাঁরা বহুদিন ধরেই এখানে বসবাস করছেন, তাদের আধার কার্ড, ভোটার আইডি, জমির দলিল, এমনকি ভারতীয় পাসপোর্টও রয়েছে। তবুও শুধু বাংলা বলার কারণে তাঁদের সন্দেহ করা হচ্ছে এবং পুলিশ বারবার হয়রানি করছে।

এই তল্লাশি আর যাচাই শুধু কাগজ দেখানোর বিষয় নয়, বরং তাঁদের জীবনের অস্তিত্বই এখন প্রশ্নের মুখে।

অনেককে বারবার থানায় ডেকে নেওয়া হচ্ছে, সেখানে অপমান করা হচ্ছে—এমন অভিযোগ করেছেন অনেক পরিবার।

জে জে কলোনির ই-ব্লকের একটি ছোট ঘরে থাকেন ২৮ বছরের শবনম ও তাঁর পরিবার। তাঁদের পরিবার বহু বছর আগে ঝাড়খণ্ডের গড্ডা জেলার হারিপুর গ্রাম থেকে দিল্লিতে এসেছিলেন। এই কলোনিতেই তাঁরা গত ১৫ বছর ধরে বাস করছেন।

শবনম জানান, তাঁর বাবা দিনমজুর, কখনো ভাড়া রিকশা চালিয়ে সংসার চালান। মা একজন গৃহকর্মী। ভাইবোনেরা দিল্লিতেই পড়াশোনা করেছে। তাঁদের সবার পরিচয়পত্র আছে।

৫ জুলাই সকালে তাঁদের বাড়িতে পুলিশ আসে ‘যাচাই’ করতে। শবনম বলেন, “পুলিশ বাবাকে বলল থানায় যেতে হবে, শুধু কাগজে সই করলেই ছেড়ে দেবে।”

কিন্তু সেই কথার আড়ালে ছিল ভয়ের এক ছায়া, অবিশ্বাস আর বারবার প্রশ্ন—তোমার দেশ কোথায়?

শবনম বলেন, “আমরা যখন থানায় গেলাম, তখন পুলিশ টাকা দাবি করে। বলে, ‘টাকা দাও, তাহলে কেস বন্ধ করে দেব’। আমরা দিতে না চাইলে ওরা বিরূপ আচরণ শুরু করে।” তাঁর অভিযোগ, পুলিশের গাড়িতে তাঁর ১২ ও ৮ বছর বয়সী দুই ভাইকে উঠিয়ে নেওয়ার পর রাতে তাঁদের বাড়িতে আবার পুলিশ আসে। তারা বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে তাঁর মাকে বাইরে ডাকে, টর্চ জ্বেলে মুখের ওপর আলো ফেলে প্রশ্ন করে।

শবনম বলেন, “আমরা পরিবারের সব সদস্যের ভোটার কার্ড, আধার কার্ড, রেশন কার্ড, এমনকি জমির দলিলও দেখিয়েছি। কিন্তু পুলিশ শুধু বলেছে, ‘তোমরা বাংলা বলো, তাই তোমরা বাংলাদেশি’। এটা আমাদের জন্য অসম্মানের শেষ সীমা।”

তাঁর অভিযোগ, এখন তাঁর মায়ের ছবি তুলে তা সব থানায় পাঠানো হয়েছে। যে কোনো সময় যে কোনো পুলিশ সদস্য তাঁদের বাড়িতে এসে মাকে ডাকতে পারে, মুখের ওপর টর্চ ফেলতে পারে, এবং দুর্ব্যবহার করতে পারে। শবনম বলেন, “এই ভয়ে রাতে ঘুমাতে পারি না।”

এই ঘটনার যন্ত্রণাটা শুধু এক দিনের নয়। শবনম জানালেন, ৫ জুলাই থেকে ৮ জুলাই পর্যন্ত টানা তিন দিন পুলিশ তাঁদের থানায় ডেকে নিয়ে গিয়েছে, প্রতিদিনই নতুন নতুন প্রশ্ন করে হয়রানি করেছে।

শুধু শবনমের পরিবার নয়, জে জে কলোনির আরও অনেক বাসিন্দাই একই অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন। সাজন নামে এক বাসিন্দা বলেন, আগে একবার তাঁকে পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছিল। সেই সময় তাঁকে এমনভাবে মারধর করা হয়েছিল যে তাঁর কান ফেটে গিয়েছিল। সাজন বলেন, “যারা আমাকে আগেও নিয়ে গিয়েছিল, তারা এত মারধর করেছিল যে কানের পর্দা ছিঁড়ে গিয়েছিল।”

এই হয়রানির হাত থেকে বাদ পড়েননি ৮০ বছর বয়সী মোহাম্মদ জাফরও। তিনি ঝাড়খণ্ডের নিজের গ্রামের বহু পুরনো জমির দলিল দেখিয়েছিলেন। কিন্তু পুলিশের ভাষ্য ছিল, “এই কাগজ টাকায়ও বানানো যায়।” এরপর পুলিশ সরাসরি তাঁকে হুমকি দেয়, বলে, “তুমি মিথ্যে বলছো। তোমাকে পাকিস্তান পাঠিয়ে দেব, বাংলাদেশ পাঠিয়ে দেব।”

জাফর এবং সাজন, উভয়ের কাছেই ভোটার কার্ড, রেশন কার্ড, আধার কার্ড, জমির কাগজ—সবকিছু থাকলেও পুলিশ তাদের পরিচয় আগেই নির্ধারণ করে ফেলেছে। কারণ একটাই—তাঁরা মুসলমান এবং বাংলা ভাষায় কথা বলেন।

জে জে কলোনির আরও অনেক বাসিন্দা অভিযোগ করেছেন, পুলিশ বারবার তাঁদের বাড়িতে আসে, মাঝে মাঝে দুই-তিন দিন ধরে ধরে রাখে তথাকথিত ‘তদন্ত’-এর নামে। কেউ কেউ বলছেন, এই সময় পুলিশ তাঁদের পরিচয়পত্রও নিয়ে নিয়েছে, এবং এখনো তা ফেরত দেয়নি।

ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-এর নেত্রী বৃন্দা কারাত ১১ জুলাই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে চিঠি লিখে এই ঘটনাগুলোর অভিযোগ তোলেন। তাঁর ভাষ্য অনুযায়ী, এই প্রক্রিয়ায় বাংলা ভাষাভাষী ভারতীয় মুসলিমদের শনাক্তকরণের নামে হয়রানি, অর্থ আদায়, এমনকি জোরপূর্বক বহিষ্কারের ঘটনা ঘটছে।

দ্য ওয়ায়ারকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বৃন্দা কারাত বলেন, “আমরা শুধু এক জায়গা নয়, পুরো জে জে কলোনি ঘুরেছি। সবাইকেই আমরা নথিপত্রসহ পেয়েছি। তবুও পুলিশ বলে, ‘তোমাদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেব’। এটা এখন স্পষ্ট যে বাংলা ভাষাভাষী মুসলমানদের টার্গেট করা হচ্ছে। সারা দেশজুড়ে এই অভিযান চলছে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে। দিল্লি পুলিশ সরাসরি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন, এবং তারা জানে, অমিত শাহ বসে আছেন। যত বেশি গ্রেফতার করবে, তত বেশি তাদের প্রমোশন হবে—এই ভাবনায় তারা কাজ করছে।”

ঠিক একই চিত্র দেখা গেছে দিল্লি লাগোয়া গাজিয়াবাদের লোনিতে। এখানে আমজাদ হোসেনের পরিবার গত ১৫ বছর ধরে বসবাস করছিল। তিনি বই ছাপার ব্যবসা করতেন। ৯ জুলাই সকালে দিল্লি পুলিশ ‘তদন্ত’-এর নামে তাঁদের বাড়িতে এসে ছয়জনকে ধরে নিয়ে যায়। গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে আছেন ২৩ বছরের আশরাফ হোসেন, ২০ বছরের ফাহমিনা খাতুন, ২৪ বছরের আকরাম হোসেন, ফাহমিনার ১৮ মাস ও ৮ মাস বয়সী দুই সন্তান, এবং এক ১৭ বছরের কিশোরী।

তাঁদের এক আত্মীয় নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “ওদের সবাইকে ৯ জুলাই সকাল ৭টার দিকে পুলিশ নিয়ে যায়। বলে, ওরা বাংলাদেশি। কিন্তু আমি স্পষ্ট করে বলছি—ওরা কেউই বাংলাদেশি নয়। ওরা বিহারের মধুবনী জেলার মানুষ এবং এখানে ১৫ বছর ধরে বসবাস করছে।”

তিনি আরও বলেন, “আমরা আধার কার্ড, প্যান কার্ড, বাচ্চাদের স্কুলের মার্কশিট, এমনকি স্নাতক ডিগ্রির সার্টিফিকেটও দেখিয়েছি। কেউ ডেলিভারি পার্টনার হিসেবে কাজ করছে, কেউ ছাপাখানার ব্যবসা চালায়। ওরা পরিশ্রমী মানুষ। কিন্তু পুলিশ শুধু বলে, ‘না, তোমরা বাংলাদেশি, তোমরা এখানে থাকতে পারবে না।’ এখন ওদের সবাইকে সরাই রোহিলা ডিটেনশন সেন্টারে রাখা হয়েছে। আমাদের পরিবার পুরোপুরি ভেঙে গেছে। ওরা ভারতের নাগরিক, আমাদের সবাই এখানেই আছে। আমাদের জীবনে এই প্রথম এমন কিছু ঘটল।”

এই ঘটনার পর আমজাদের বাড়ি এখন তালাবদ্ধ। তিনি ও তাঁর স্ত্রী এলাকা ছেড়ে পালিয়ে গেছেন, কারণ তাঁদের ভয়—পুলিশ আবার আসবে।

পরিবারের আইনজীবী আদিত্য আগরওয়াল জানিয়েছেন, গ্রেফতার হওয়া ছয়জনের জন্য আদালতে একটি সুরক্ষামূলক আবেদন দাখিল করা হয়েছে এবং আদালত বিদেশি নিবন্ধন দপ্তর ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে এর জবাব চেয়েছে। পরবর্তী শুনানির দিন ঠিক হয়েছে ১৪ আগস্ট ২০২৫।

দ্য ওয়্যার থেকে উত্তর-পূর্ব দিল্লি পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও এখন পর্যন্ত কোনো উত্তর মেলেনি।


Logo

ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন