
বাংলাদেশের কক্সবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের সংখ্যা এখন ১০ লাখের বেশি। তাঁরা সবাই আশ্রয় নিয়েছেন অস্থায়ী তাবুতে গঠিত শিবিরে। এসব ক্যাম্পে জীবনের মৌলিক চাহিদাগুলোও পূরণ হয় না — নেই নিরাপত্তা, নেই স্থায়ী ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা। ছবি: রয়টার্স
গত মাসে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির নেতা আতাউল্লাহ আবু আম্মার জুনুনির গ্রেপ্তারকে অনেকে রোহিঙ্গা জঙ্গিবাদের ওপর আঘাত হিসেবে দেখেছেন। কিন্তু বাস্তবে এটি নতুন করে চরমপন্থার পথ খুলে দিতে পারে বলে আশঙ্কা বাড়ছে। মিয়ানমারের নিপীড়িত সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গারা বর্তমানে চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে। তারা নাগরিকত্বহীন, মানবিক সহায়তা কমে গেছে, পুরনো মিত্রদের কাছ থেকেও ত্যাগের শিকার হয়েছে।
এমন এক সময় যখন তাদের আশা প্রায় নিঃশেষ, তখন চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলো এই শূন্যতা কাজে লাগাতে চাইছে। অতীতে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী দীর্ঘদিন ধরে নির্যাতনের শিকার হওয়ায় প্রতিরোধের ভাষা হয়ে উঠেছিল সহিংসতা। বর্তমান পরিস্থিতিও তেমন একটি নতুন সহিংস বাস্তবতা তৈরি করতে পারে। এমনকি পাকিস্তানের লস্কর-ই-তৈয়বার মতো আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীগুলোও এই সুযোগে হস্তক্ষেপ করতে পারে।
রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সংগ্রাম বহু প্রজন্ম ধরে চলে আসছে। ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইনের মাধ্যমে মিয়ানমার সরকার তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়। এরপর থেকে তাদের বসবাসের জায়গা রাখাইন রাজ্যে তারা পরিণত হয় রাষ্ট্রহীন অবস্থায়। সেনাবাহিনীর ভয়াবহ অভিযান, বিশেষ করে ২০১৭ সালের তথাকথিত ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’-এ হাজার হাজার মানুষ নিহত হয় এবং ৭ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। জাতিসংঘ এটিকে ‘জাতিগত নিধনের পাঠ্যবইয়ে থাকা উদাহরণ’ বলেছিল।
এই সহিংসতা থেকেই আতাউল্লাহর নেতৃত্বে ২০১৬ সালে গড়ে ওঠে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি। এদের হামলা খুব পরিকল্পিত ছিল না, অস্ত্র ছিল সাদামাটা, তবে এসব হামলা সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে ভয়াবহ প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়। এটাই রোহিঙ্গাদের দুর্দশা আরও বাড়িয়ে দেয়।
আতাউল্লাহর সংগঠন আদর্শ নয়, বরং অস্তিত্ব রক্ষার চেষ্টা থেকে গড়ে উঠেছিল। এর আগেও ১৯৮০ সালের দশকে রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন নামে একটি গোষ্ঠী একইভাবে প্রতিরোধ গড়তে চেয়েছিল, তবে তারা একতা বা সামর্থ্য কিছুই গড়ে তুলতে পারেনি। আরএসএ-ও সীমিত পরিসরে কাজ করত, কিন্তু এটি সেই জনগোষ্ঠীর কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছিল যাদের আর কোনো রাস্তা খোলা ছিল না। এই চরমপন্থা ছিল রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ন এবং আন্তর্জাতিক উদাসীনতার ফল।
আতাউল্লাহর গ্রেপ্তারের ফলে অনেকে ভেবেছিলেন জঙ্গিবাদ দুর্বল হবে। কিন্তু এতে উল্টো রোহিঙ্গাদের ভঙ্গুর অবস্থা সামনে এসেছে। রাজনৈতিক বিকল্প না থাকায় অনেকেই শেষ আশ্রয় হিসেবে চরমপন্থার দিকে ঝুঁকছেন।
এর পেছনে তিনটি বড় কারণ কাজ করছে।
প্রথমত, মিয়ানমারে ২০২১ সালের সেনা অভ্যুত্থানের পর গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে। এর ফলে সম্ভাব্য মিত্র আরাকান আর্মি, যারা রাখাইন বৌদ্ধ বিদ্রোহী গোষ্ঠী, রোহিঙ্গাদের ওপর হামলা শুরু করেছে। দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট জানিয়েছে, তারা রোহিঙ্গা গ্রামবাসীদের জোর করে সেনায় নিয়োগ করছে এবং বসতিচ্যুত করছে। এর মাধ্যমে স্পষ্ট হয়েছে যে, জান্তা-বিরোধীরাও রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের বৈধ নাগরিক বলে মানতে রাজি নয়।
দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের কক্সবাজারে অবস্থিত রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোতে মানবিক সংকট আরও গভীর হয়েছে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি বাজেট সংকটে পড়ায় খাদ্য বরাদ্দ অর্ধেকে নামিয়ে আনছে। মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, এর ফলে শরণার্থীদের মধ্যে পুষ্টিহীনতা ও হতাশা বাড়বে। দ্য ইন্ডিপেনডেন্টকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ২৫ বছর বয়সী মোহাম্মদ আয়াস জানিয়েছেন, ক্যাম্পে জীবনের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। তিনি মিয়ানমারে একটি বিদ্রোহী গোষ্ঠীর প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছেন। তার ভাষ্য অনুযায়ী, বেঁচে থাকার প্রশ্নে সহিংসতাই হয়ে উঠছে বাস্তব পথ।
তৃতীয়ত, আন্তর্জাতিক মনোযোগ এখন অন্যত্র সরে গেছে। ইউক্রেন ও গাজার যুদ্ধ এখন শিরোনামে, অথচ মিয়ানমারের সংকট ধীরে ধীরে ভোলার উপক্রম। অং সান সু চি কারাগারে, তার নীরবতা এখন আর আলোচ্য নয়। প্রত্যাবাসনের কোনো অগ্রগতি নেই। তাই রোহিঙ্গারা তাদের মাতৃভূমি ফিরে পাওয়ার আশা হারাচ্ছেন।
এই শূন্যতা চরমপন্থার জন্য উর্বর জমি তৈরি করছে। আতাউল্লাহর গ্রেপ্তার কোনো সমস্যার সমাধান করেনি, বরং নতুন বিভক্তি তৈরি করেছে। এতে আরও চরমপন্থী গোষ্ঠীর উত্থান ঘটার সম্ভাবনা বাড়ছে। মিয়ানমারের জঙ্গলে প্রশিক্ষণ নেওয়া যুবক আয়াস সরাসরিই বলেছেন, “আমরা আমাদের মাতৃভূমি ফিরে চাই এবং তার জন্য লড়ব।” এই ধরনের হতাশা এবং সংকল্পকে চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলো নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগাতে পারে।
ইতিহাস বলে, যখন স্থানীয় প্রতিরোধ দুর্বল হয়ে পড়ে তখন আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনগুলো হস্তক্ষেপ করে। লস্কর-ই-তৈয়বা যেমন ২০০৮ সালের মুম্বাই হামলার জন্য কুখ্যাত, তেমনি অতীতে আফগানিস্তান ও কাশ্মীরে তারা বিভিন্ন মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে সক্রিয় ছিল। দক্ষিণ এশিয়ার কাছাকাছি এবং রাষ্ট্রহীন অবস্থায় থাকা রোহিঙ্গারা তাদের পরবর্তী লক্ষ্য হতে পারে।
দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট জানায়, কক্সবাজারে গোপনে চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলো রিক্রুটমেন্ট শুরু করেছে। লস্কর-ই-তৈয়বা বা একই রকম ধর্মীয় পরিচিতি ও কৌশলগত উদ্দেশ্যসম্পন্ন সংগঠন যদি এখানে সক্রিয় হয়, তাহলে এই সংঘাত ছড়িয়ে পড়তে পারে মিয়ানমার ছাড়িয়ে পুরো অঞ্চলে।
রোহিঙ্গাদের চরমপন্থার পথে যাওয়া অবশ্যম্ভাবী নয়, কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি ভয়াবহ ইঙ্গিত দিচ্ছে। আরাকান আর্মির শত্রুতা এবং জান্তার জোরপূর্বক রিক্রুটমেন্ট তাদের সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। ক্যাম্পে খাদ্য সংকট ও আন্তর্জাতিক অবহেলা তাদের ঠেলে দিচ্ছে সশস্ত্র পথে। যারা সহিংসতাকে একমাত্র সমাধান হিসেবে তুলে ধরছে, তারা এই বিপর্যয়কে ব্যবহার করছে।
রোহিঙ্গারা প্রকৃতপক্ষে সহিংস নন, তারা একটি নিরুপায় জনগোষ্ঠী যাদের প্রান্তে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এই সংকট থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় হচ্ছে—মিয়ানমারকে নাগরিকত্ব দিতে বাধ্য করা, আন্তর্জাতিক সহায়তা বাড়ানো এবং আরাকান আর্মি ও রোহিঙ্গাদের মধ্যে সংলাপ প্রতিষ্ঠা করা। তা না হলে আতাউল্লাহর গ্রেপ্তার চরমপন্থা থামাবে না, বরং নতুন রূপে হাজির হবে। বিশ্ব এর আগেও রোহিঙ্গাদের আর্তনাদ উপেক্ষা করেছে। এবার আর তা করার সুযোগ নেই। [আরব নিউজ থেকে]
ড. আজিম ইব্রাহিম: ডিরেক্টর, নিউলাইনস ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড পলিসি, ওয়াশিংটন ডিসি (এক্স: @AzeemIbrahim)