আযমী সাহেবের বক্তব্যের বিষয়ে জামায়াত ব্যাখ্যা দেবে কি?
মোজাব্বীর হাসান
প্রকাশ: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:৫৭ পিএম
আব্দুল্লাহিল আমান আযমী। ছবি: সংগৃহীত
মঙ্গলবার (৩ সেপ্টেম্বর) থেকেই দেখছি জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির প্রয়াত গোলাম আযম সাহেবের পুত্র বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুল্লাহিল আমান আযমী বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তন করে নতুন জাতীয় সঙ্গীতের কথা বলেছেন—এমন তথ্য সামাজিক যোগাযোগমাধমে ঘুরছে।
আমি ফেসবুকে সার্চ দিয়ে আজ মিস্টার আযমীর সংবাদ সম্মেলনে দেয়া বক্তব্যটি শুনলাম। দেড় ঘন্টার বেশি সময়ের লাইভটি শুনতে আমাকে বেশ ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হলো।
মূলত, নিপীড়ক রাষ্ট্রের গুমঘর আয়নাঘরে বন্দি থাকা অবস্থার অভিজ্ঞতা, সেনাবাহিনী থেকে তার পদচ্যুতি, এবং বর্তমানে এ বিষয়ে বর্তমান সেনা প্রধানের কাছে ন্যায়বিচারের প্রত্যাশা ইত্যাদি বিষয় সামনে নিয়ে তিনি বক্তব্য দিয়েছেন। এর সঙ্গে বাংলাদেশের সংবিধান, জাতীয় সঙ্গীতসহ আরো কয়েকটি বিষয় তিনি সামনে এনেছেন, যা নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা চলছে। অনেকেই তার বক্তব্য ও দাবিকে বিতর্কিত বলে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
এক মাসও হয়নি, শেখ হাসিনার অগণতান্ত্রিক কর্তৃত্ববাদী দানবিক সরকার ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বিদায় নিয়েছে। দেশের মানুষের মাঝে একটি উদারবাদী গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষা হাজির হয়েছে। ন্যায়বিচার ও ন্যায্যতার সমাজ-রাষ্ট্র নির্মাণের মাধ্যমে সে আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন দেখার অপেক্ষায় জনগণ। সবার প্রত্যাশা একটি একতার সমাজ। স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে দরকার জাতীয় ঐকমত্য। তাছাড়া এই অভ্যুত্থানের ফলেই তো আয়নাঘরের মতো বন্দিশালা থেকে মুক্তি পেয়েছেন আযমীর মতো বন্দিরা। যারা ছিলেন রাষ্ট্র কর্তৃক মানবাধিকার লঙ্ঘনের চূড়ান্ত উদাহরণ। ফলে রাষ্ট্রের মেরামত ও নতুন নির্মাণের প্রশ্নটি প্রধান হয়ে সামনে এসেছে।
তো, আমরা সংবাদ সম্মেলনে দেয়া মি. আযমীর বক্তব্যের প্রসঙ্গে আসি। আমি যে লাইভটি শুনেছি, তা প্রচারিত হয়েছে জামায়াত, ঢাকা সাউথের ফেসবুক পেজ থেকে। সেখান দেয়া তার বক্তব্যে থেকে কয়েকটি বিষয় পয়েন্ট আকারে নিচে তুলে ধরছি:
এক.
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ও এবারের শেখ হাসিনা সরকারের পতনের গণঅভ্যত্থান নিয়ে তিনি বলেছেন, ১৯৭১ সালে হয়েছিল 'প্রথম মুক্তিযুদ্ধ'। এবার হয়েছে 'দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ'। মুক্তিযুদ্ধ শব্দটিই তিনি বলেছেন। এই বলে তিনি দাবি করেছেন, প্রথম মুক্তিযুদ্ধে যেমন শহীদ ও আহতদেরকে বীরশ্রেষ্ঠ, বীরউত্তম, বীর প্রতীক খেতাব দেওয়া হয়েছে, এবারের দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধেও যারা শহীদ বা আহত হয়েছেন তাদেরকে একই রকম বীরশ্রেষ্ঠ, বীরউত্তম ইত্যাদি খেতাব দেওয়া হোক।
দুই.
বিডিআর বিদ্রোহের ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তা হত্যা ও বিচার প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, পবিত্র কোরআনে আছে, খুনের বদলা খুন। 'আমি খুনের বদলা খুন চাই'।
তিন.
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে তিনি বলেছেন, এটা ৩০ লক্ষ না ৩ লক্ষ, সে সত্যিকারের ইতিহাস মানুষকে জানতে দিন। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেন, শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি ঢাকায় ফিরে ৩ লক্ষ বলতে গিয়ে ৩ মিলিয়ন বলে ফেলেছিলেন। এ প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেছেন, এই সংখ্যা দুই লাখ ৮৬ হাজার হতে পারে, এমনটা শোনা গিয়েছিল।
চার.
বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, এই জাতীয় সংগীত রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছিলেন বঙ্গভঙ্গের সময়। দুই বাংলা এক করার জন্য। এই জাতীয় সঙ্গীত স্বাধীন বাংলার অস্তিত্বের পরিপন্থী। এটি রচিত হয়েছিল কলকাতার গড়ের মাঠে। ভারত স্বাধীন বাংলাদেশে অস্থিরতা তৈরির জন্য এই জাতীয় সঙ্গীত আমাদের উপর চাপিয়ে দিয়েছিল। তাই নতুন জাতীয় সঙ্গীত তৈরি করা হোক—তিনি এ দাবি করেছেন।
নতুন জাতীয় সঙ্গীত কি হতে পারে এ রকম প্রশ্নে তিনি বলেছেন, 'ধনধান্যে পুষ্পে ভরা' 'প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ' 'এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি'—এ রকম কিছু হতে পারে। অথবা নতুন করে কিছু হতে পারে।
পাঁচ.
বাংলাদেশের সংবিধান সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ১৯৭০ সালের নির্বাচিতরা ১৯৭২ সালে এ সংবিধান বানিয়েছিলেন। এ কথা উল্লেখ করে তিনি দাবি করেছেন, এই সংবিধান বৈধ নয়, এই সংবিধান বাতিল করা হোক। সংবিধান প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেছেন, এটা ৯২-৯৩ বা নাইনটি প্লাস মুসলমানের দেশ। সেখানে সংবিধানে লেখা আছে 'সার্বভৌমত্বের মালিক জনগণ'। তিনি বলেছেন, সার্বভৌমত্বের মালিক জনগণ তা ঠিক নয়। 'সার্বভৌমত্বের মালিক একমাত্র আল্লাহ'। আল্লাহর আইনের বিরোধী কোনো আইন বাংলাদেশের সংবিধানে থাকতে পারবে না।
ছয়.
বিবিসির জরিপে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, বিবিসির জরিপ একটি তামাশা। এবং এটা হাস্যকর।
এ প্রসঙ্গে তিনি তার বাবার কথা বলেন। তার বাবার কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন, আমার বাবা বলে নয়, অধ্যাপক গোলাম আযম ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ বাঙালি/বাংলাদেশি। 'তিনি ইতিহাসের মুকুটহীন রাজা'। এ প্রসঙ্গে তিনি তার বাবার নাগরিকত্ব মামলাসহ নানা প্রসঙ্গ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, আমার বাবা একজন শ্রেষ্ঠ মুসলমান, শ্রেষ্ঠ মুত্তাকী ছিলেন।
সাত.
সেনাবাহিনী থেকে তার পদচ্যুতির বিষয়ে একটি উচ্চতর কমিটি হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেছেন, তিনি ন্যায়বিচার পাবেন এমনটাই প্রত্যাশা। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার তার ছাত্র ছিলেন। তাছাড়া সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতে জেনারেল ওয়াকারের ভূমিকার প্রশংসা করে তিনি ধন্যবাদ জানান।
সর্বশেষ তিনি বলেছেন, আমি এখন অসুস্থ। আমি একজন দেশপ্রেমিক। আমি দেশের জন্য কাজ করতে চাই।
উপরে উল্লিখিত বক্তব্যগুলো তার নিজস্ব বা ব্যক্তিগত। এ বিষয়ে নানা পক্ষের রাগ-ক্ষোভ আমরা দেখতে পাচ্ছি। ইতিহাসের বিচারে তা স্বাভাবিক। তার উত্থাপিত প্রসঙ্গের পক্ষেও যে এ দেশে কোনো লোক নেই, তাও তো না। নিশ্চয়ই আছে। সে সংখ্যা কত, সে বিচারেও এখানে আমরা যাচ্ছি না। তবে, মানবাধিকার পরিপন্থী আয়নাঘরের একজন বন্দির মুক্তি উপলক্ষে দেয়া বক্তব্য শোনার পরে একটা প্রসঙ্গে আপাতত বলার জরুরত আছে বলে মনে করছি।
জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পরে এদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা ও জামায়াত প্রশ্নে রাজনীতি সচেতন নাগরিকের মনে কিছু উৎকণ্ঠা ছিল। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা, রাষ্ট্রসংস্কারের প্রশ্ন, ইত্যাদিতে জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকা প্রশংসা পেয়েছে। এবার দলটির আমীর ডা. শফিকুর রহমানের বক্তব্যও নানা মহলে ইতিবাচকভাবে আলোচিত হয়েছে। ১৯৭১ ও তৎপরবর্তী রাজনীতিতে জামায়াতের বিতর্কিত ভূমিকাকে পাশে রেখে, একটি নতুন উদারবাদী গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ নির্মাণে তারা কতটুকু এগিয়ে আসবেন, তাও দেখতে চেয়েছেন অনেকে।
ঠিক এই মুহূর্তে জামায়াতের সাবেক আমির অধ্যাপক গোলাম আযমের চতুর্থ পুত্র অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুল্লাহিল আমান আযমীর বক্তব্যে উত্থাপিত সংবিধান, জাতীয় সঙ্গীত ইত্যাদি প্রসঙ্গ নিয়ে যে বিতর্ক সামনে এসেছে, তা নিয়ে দলটি তাদের অবস্থান পরিষ্কার করে কি কোনো বক্তব্য বা বিবৃতি দিয়েছে? দিয়ে থাকলেও আমার চোখে পড়েনি। না দিয়ে থাকলে, ডা. শফিকুর রহমান যে নতুন জামায়াতের চেহারা আমাদের দেখাতে চাচ্ছেন, সে প্রয়োজনেই রাজনৈতিক দল হিসাবে একটি বিবৃতি তাদের কাছে আমরা প্রত্যাশা করি। অভ্যুত্থানের শক্তিশালী অংশ জেন-জিও আগামীতে ইতিহাসের এসব পাঠ নিয়ে শক্তিশালীভাবেই আবির্ভূত হবে বলে মনে হয়। আমাদের সামনে জলজ্যান্ত প্রমাণ হিসাবে হাজির আছে যে ইতিহাস, সে ইতিহাস বলছে, সময়ই সবচেয়ে বড় বিচারক।
তাছাড়া, আমরা মনে করি, আব্দুলিল্লাহিল আমান আযমী তার বক্তব্যে যেসব প্রসঙ্গ ও দাবি হাজির করেছেন, তার বেশ কয়েকটিই ১৯৭১-এর জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মৌলিক বিষয়রে সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এসব মূল নীতিসমূহ নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হলে তা এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। যদিও এগুলো তার ব্যক্তিগত মত, কিন্তু এর রাজনৈতিক গুরুত্বও দেখতে হবে। যেহেতু আযমী সাহেব কোনো সাধারণ নাগরিক নন। তিনি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অংশ বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর একজন সাবেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। অপরদিকে, তিনি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নীতি-নির্ধারকদের অন্যতম একজন ও প্রভাবশালী আমীর প্রয়াত গোলাম আযমের সন্তান। বাবার নীতি-আদর্শের প্রশ্নেও আপসহীন অবস্থান তার রয়েছে। তাছাড়া সংবাদ সম্মেলনে দেয়া তার বক্তব্যটিও প্রচারিত হয়েছে জামায়াতের একটি ফেসবুক পেইজ থেকে। তার মানে রাজনৈতিক দল হিসাবে মি. আযমীর সঙ্গে জামায়াতের সংশ্লিষ্টতাও অপ্রকাশ্য নয়। সব দিক বিবেচনা করে আমরা বলতে পারি, রাজনৈতিক দল হিসেবে এক্ষেত্রে জামায়াত ইসলামীর উচিত হবে উত্থাপিত বিষয়গুলো নিয়ে তাদের দলীয় অবস্থান পরিষ্কার করা।
এ বিষয়ে তাদের কোনো ব্যাখ্যা বা বক্তব্য সামনে পেলে, আগামীতে কেমন রাজনীতি ও দেশ তারা চান তা সবার সামনে কিছুটা পরিষ্কার হবে। সব দিক বিবেচনা করে এটা বলা যায়, জামায়াতে ইসলামীর উচিত হবে এ বিষয়ে একটি বক্তব্য হাজির করা।
মোজাব্বীর হাসান: সংবাদ মাধ্যম কর্মী