ইকোনমিক টাইমসের প্রতিবেদন
শেখ হাসিনা: মিত্রকে ক্ষমতাচ্যুত করায় ভারতের কূটনৈতিক টানাপড়েন
বাংলাদেশের স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতাচ্যুতি ঢাকায় উদযাপনের আনন্দ দিয়েছে। কিন্তু প্রতিবেশী ভারতে শঙ্কা তৈরি করেছে। প্রতিদ্বন্দ্বী চীনকে মোকাবেলা করতে এবং ইসলামপন্থী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে প্রতিহত করতে শেখ হাসিনা ছিলেন ভারতের অকৃত্রিম বন্ধু।
৭৬ বছর বয়সী হাসিনা গত ৫ আগস্ট ছাত্র-নেতৃত্বাধীন বিদ্রোহের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দেন এবং হেলিকপ্টারে করে দীর্ঘদিনের মিত্র নয়াদিল্লিতে আশ্রয় নেন।
বাংলাদেশের সদ্য শপথ নেওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের নেতা মুহাম্মদ ইউনূস বৃহস্পতিবার ক্ষমতায় আসার পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিই তাকে প্রথম শুভেচ্ছা জানিয়েছেন, বলেছেন, নয়াদিল্লি ঢাকার সাথে কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
চীনও ঢাকার নতুন কর্তৃপক্ষকে স্বাগত জানাতে তৎপর ছিল, বলেছে, তারা সম্পর্কের ‘উন্নয়নে গুরুত্ব দেয়’।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের বিশ্লেষক থমাস কিন বলেন, ‘বাংলাদেশিদের দৃষ্টিকোণ থেকে, ভারত কয়েক বছর ধরে ভুল পথে রয়েছে। ভারত সরকার একেবারেই ঢাকায় পরিবর্তন দেখতে চায়নি এবং বছরের পর বছর ধরে এটা পরিষ্কার করে দিয়েছিল যে, তারা হাসিনা ও আওয়ামী লীগের কোনো বিকল্প দেখছে না।’
বাংলাদেশ প্রায় সম্পূর্ণভাবে ভারতবেষ্টিত। ১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে বিভক্ত হওয়ার অনেক আগে থেকেই বাংলাদেশ গভীরভাবে জড়িয়ে আছে ভারতের ইতিহাসের সাথে।
কিন্তু হাসিনা ভারত এবং আধিপত্যশীল চীনকেও সমর্থন করেছেন।
ভারত এবং চীন, বিশ্বের দুটি সর্বাধিক জনবহুল দেশ, নেপাল, শ্রীলঙ্কা এবং মালদ্বীপসহ দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে কৌশলগত প্রভাব সৃষ্টিতে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বী।
ওয়াশিংটন-ভিত্তিক উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বলেছেন, ‘ভারত চিন্তা করছে যে, হাসিনা ও আওয়ামী লীগের বিকল্প কোনো সরকার ভারতীয় স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। নয়াদিল্লির দৃষ্টিতে, বিএনপি এবং তার মিত্ররা বিপজ্জনক ইসলামি শক্তি যা ভারতীয় স্বার্থকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।‘
এখন ইউনূস বলছেন, তিনি কয়েক মাসের মধ্যে বাংলাদেশে নির্বাচন চান।
আর বিএনপি ঢাকায় গণসমাবেশ করে প্রত্যাবর্তনের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে।
হাসিনার পতনের অব্যবহিত পরে, হিন্দুদের মালিকানাধীন কিছু ব্যবসা এবং বাড়িঘর আক্রমণ করা হয়েছিল। এখানে বাংলাদেশের একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কথা মনে রাখতে হবে। মনে রাখতে হতে হবে, সম্প্রতি শত শত বাংলাদেশি হিন্দু ভারতের সীমান্তে এসেছে।
হিন্দু জাতীয়তাবাদী নেতা মোদি বৃহস্পতিবার বলেছেন, তিনি হিন্দু ও অন্য সমস্ত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করে দ্রুত বাংলাদেশ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসার আশা করছেন।
হাসিনা ফিরে যাবেন
হাসিনার ভারতে আশ্রয় নয়াদিল্লি ও ঢাকার মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুব্রহ্মণ্যম জয়শঙ্কর সংসদে বলেছেন, হাসিনা খুব স্বল্প সময়ের নোটিশে ভারতে উড়ে এসেছেন এবং ভারতীয় মিডিয়ার মতে, ট্রানজিটে অল্প সময়ের জন্য থাকার ইচ্ছা ছিল হাসিনার, কিন্তু তিনি কত দিন থাকবেন তা এখনও বলা যাচ্ছে না।
ব্রিটেনে যাওয়ার জন্য হাসিনার কথিত বিড বাতিল হয়ে যায় যখন লন্ডন একটি ‘পূর্ণ ও স্বাধীন জাতিসংঘের নেতৃত্বে তদন্ত’ করার আহ্বান জানায়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অতীতে হাসিনার অর্থনৈতিক রেকর্ডের প্রশংসা করেছিল এবং তাকে ইসলামপন্থী চরমপন্থা মোকাবেলার মতো অগ্রাধিকারের অংশীদার হিসাবে দেখেছিল, কিন্তু ওয়াশিংটন সম্প্রতি গণতন্ত্রের বিষয়ে উদ্বেগের জন্য ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।
নয়াদিল্লির কাছে সামরিক বিমানঘাঁটিতে আসার পর থেকে হাসিনাকে একটি গোপন সেফ হাউসে রাখা হয়েছে এবং প্রকাশ্যে কথা বলেননি তিনি।
তার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ বলেছেন, তিনি শুনছেন কিন্তু দেখেননি হাসিনাকে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রধান সায়মা ওয়াজেদ সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম এক্সে একটি পোস্টে বলেছেন, ‘মাকে দেখতে আমি যতটা পছন্দ করি, আমি তার অবস্থান নিয়ে কোনোভাবেই আপস করতে চাই না।’
ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় টাইমস অফ ইন্ডিয়া পত্রিকাকে বলেছেন, তার মা এখনও রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় শামিল হবেন বলে তিনি আশা করছেন।
তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিলেই তিনি (হাসিনা) বাংলাদেশে ফিরে যাবেন।
শত্রুতা অর্জন
ভারত এখন যে ‘প্রবল কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জের’ মুখোমুখি হচ্ছে সে সম্পর্কে দেশটির গণমাধ্যম সতর্ক করেছে।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস সতর্ক করে দিয়েছে, ‘নয়া দিল্লিকে অবশ্যই ক্ষয়ক্ষতি সীমিত করতে সক্রিয়ভাবে কাজ করতে হবে, এবং সম্পর্কের উচ্চ অংশীদারি সুরক্ষিত আছে তা নিশ্চিত করতে হবে। এতে সাময়িক কিছু বিপত্তি দেখা দিতে পারে।’
কিন্তু বাংলাদেশের নতুন নেতা ইউনূস বন্ধুত্ব পুনরুদ্ধারের প্রস্তাব দিয়েছেন। তার ভাষায়, ‘যদিও কিছু দেশ, যেমন ভারত, ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রীকে সমর্থন করেছে এবং এর ফলে বাংলাদেশি জনগণের শত্রুতা অর্জন করেছে, তবে এ ধরনের ফাটল সারানোর অনেক সুযোগ থাকবে।’ ইউনূস বাংলাদেশে ফেরার কিছুক্ষণ আগে দ্য ইকোনমিস্টে লিখেছেন।
ক্রাইসিস গ্রুপের কিন ইতিমধ্যে বলেছেন, তিনি বিশ্বাস করেন, দেশগুলো বাস্তবিক সম্পর্কের জন্য অতীতকে একপাশে রাখবে। তার ভাষায়, ‘ভারত বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক অংশীদার, এবং তাদের এগিয়ে যাওয়ার পথ খুঁজে না পাওয়ার কোনো কারণ নেই। অর্থনৈতিক শক্তি তাদের একসাথে কাজ করতে বাধ্য করবে।‘